উচ্চশিক্ষিত তরুণের আদর্শ গরুর খামার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন চারুকলায়। কিন্তু চাকরির পেছনে কোনদিনই ছোটেননি। চারুকলার সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে করেন একটি আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান। এরপর গরুর খামার। আমেরিকান ‘ব্রাহামা’ জাতের গরু পালনে সফল হয়ে অন্য উদ্যোক্তাদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছে ইয়াসির আরাফাত রুবেল নামে উচ্চশিক্ষিত এ তরুণের খামারটি।

নগরীর উপকণ্ঠ বিনোদপুর আবহাওয়া অফিসের পেছনেই রুবেলের খামার। নাম ‘সওদাগর অ্যাগ্রো’। খামারটি এই জন্য আদর্শ যে আমেরিকান ‘ব্রাহামা’ জাতের গরু পালন করে রাজশাহীর অনেক প্রান্তিক চাষি যখন সফলতা পাননি, তখন রুবেল দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে খামারে এই গরু পালন করা যায়। এখন শুধু রাজশাহীই নয়, দেশের নানা প্রান্তের তরুণ উদ্যোক্তারা রুবেলের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।

এদিকে করোনাকালে কোরবানির পশুর জন্য যারা হাটে যেতে চাইছেন না তারা অনলাইনেই রুবেলের গরু দেখছেন। এরই মধ্যে তার ব্রাহামা জাতের ছয়টি গরু বিক্রি হয়েছে। চট্টগ্রামে দুটি, ঢাকায় একটি, কুমিল্লায় একটি ও রংপুরে দুটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি। দাম পেয়েছেন ১৬ লাখ টাকা। রুবেল জানান, গরুগুলোর একেকটির ওজন হয়েছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ কেজি। আর এক বছর খামারে রাখতে পারলে ওজন হাজার কেজি ছাড়িয়ে যেত। রুবেল বলেন, তার মতো করে যদি একজন ছোট চাষিও গরু পালন করেন তাহলে তিনি লাভ করবেন।

২০১৮ সালে রুবেল ২০টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল ১২টি ব্রাহামা জাতের গরু। ব্রাহামা পালন করে তিনি এখন সফল। অথচ ২০১৫ সালের দিকেই একটি প্রকল্পের মাধ্যমে চাষি পর্যায়ে ব্রাহামার বীজ সরবরাহ করেছিল জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর। কিন্তু তখন এত সফলতা দেখা যায়নি।

রুবেল কীভাবে সফল হলেন, সে কথা বলছিলেন নিজেই। তার ভাষ্যমতে, একটি ব্রাহামা জাতের বাছুর জন্মের পর ৭ থেকে ৮ লিটার দুধ পান করে। কিন্তু দেশি জাতের একটি গাভীর এত দুধ হয় না। সে কারণে ব্রাহামা জাতের গরুর একটু উন্নত খাবারের প্রয়োজন হয়। তিনি খামার করে জমিতে দ্রুতবর্ধনশীল উন্নত জাতের ঘাস চাষ করেছেন। পাশাপাশি নিজের বাড়িতেই মাটি ছাড়াই উৎপাদন করছেন চীন থেকে আনা দ্রুতবর্ধনশীল জারা-১ জাতের ঘাস। এসব ঘাসেই মিটেছে ব্রাহামার খাদ্যের চাহিদা।

খামার শুরুর গল্পটাও শোনালেন আরাফাত রুবেল। তিনি জানান, খবরের কাগজে দেখেন, আমেরিকা থেকে ১১ লাখ টাকা বিমানভাড়া দিয়ে আনা ব্রাহামা জাতের একটি গরু বিক্রি হয়েছে ৩৭ লাখ টাকায়। গরুটি দেশে দুই বছর পালন করা হয়েছিল। তিনি চিন্তা করেন, এই গরু যদি দেশেই পালন করা যায় তাহলে প্রচুর মাংস উৎপাদন হবে। বিমানভাড়াও লাগবে না। কম খরচে বেশি লাভও হবে। তিনি গরুর খামার করার পরিকল্পনা করেন। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানের বড় বড় খামার ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ভারতের পাঞ্জাব, গুজরাট গিয়েও চাষিদের গরু পালন দেখে আসেন। এরপর ব্রাহামার সিমেন্স নিতে যান প্রাণিসম্পদ দপ্তরে।

কিন্তু তাকে জানানো হয়, প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেছে। এখন সিমেন্স দেয়া হচ্ছে না। মন খারাপ হয় রুবেলের। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে যেসব চাষির গাভীকে ব্রাহামার সিমেন্স দেয়া হয়েছে তাদের তালিকা সংগ্রহ করেন। এরপর রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের নানা প্রান্তের কৃষকের বাড়ি থেকে কিনে আনেন ব্রাহামার বাছুর। এরই মধ্যে গাজীপুরে ন্যাশনাল লাইভস্টক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ঘাস চাষ ও পশু পালনের ওপরে প্রশিক্ষণ নেন। পরিকল্পনার একটা লম্বা সময় পর শুরু হয় খামার।

রুবেল খামারে পরীক্ষামূলকভাবে সমপরিমাণ খাবার দিচ্ছেন একটি দেশি গরুকে। দেখা যাচ্ছে, একই সময়ে একই পরিমাণ খাবার খেয়ে দেশি গরুর ওজন হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় মণ। আর ব্রাহামার ওজন হয়েছে ১৫ মণ।

রুবেলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আমেরিকায় দুই বছরে একটি ব্রাহামার যে ওজন হবে সেটা বাংলাদেশে সময় লাগবে আড়াই বছর। আবহাওয়াসহ এর নানা কারণ আছে। ব্রাহামা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় সুস্থ থাকতে পারে। বরেন্দ্রের খরতাপে তার খামারের গরুগুলো যেন অসুস্থ হয়ে না পড়ে সে জন্য প্রতিটি গরুর কাছে দিয়েছেন ছোট ছোট বৈদ্যুতিক পাখা। খামার রাখেন সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ভেতরে কোন দুর্গন্ধ নেই। সব কাজ নিজেই করেন তিনি।

বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রুহুল আমিন-আল ফারুক বলেন, আরাফাত রুবেলের মতো দক্ষ খামারিদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হবেন। রুবেল ব্রাহামার খামার করে সফলতার দৃষ্টান্ত গড়েছেন। তার গরু এখন অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে। করোনাকালে এটিও দেশের জন্য একটা বড় সুফল। এখন হাটে যত চাপ কমবে করোনার সংক্রমণও তত কম হবে।