শেরপুরের নকলায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে বর্বরোচিত নির্যাতন করার খবর পাওয়া গেছে। নির্যাতনে ওই গৃহবধূর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে।
সোমবার (১০ জুন) রাতে ওই ঘটনার ভিডিওচিত্র ফাঁস হওয়ায় এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
নির্যাতিত ওই গৃহবধূর নাম ডলি খানম (২২)। তিনি পৌর শহরের কায়দা এলাকার দরিদ্র কৃষক শফিউল্লাহর স্ত্রী ও স্থানীয় চন্দ্রকোনা কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
এ ঘটনার নায়ক নির্যাতিতা গৃহবধূর ভাসুর আবু সালেহসহ জড়িতরা এখনও বুক ফুলিয়ে এলাকায় বিচরণ করছে।
সুত্রে জানা গেছে, নকলা পৌর শহরের উপকণ্ঠ কায়দা গ্রামের মৃত হাতেম আলীর পুত্র মো. শফিউল্লাহর সাথে এক খণ্ড জায়গা নিয়ে তার সহোদর বড়ভাই আবু সালেহ (৫২), নেছার উদ্দিন (৪৮) ও সলিম উল্লাহর (৪৪) বিরোধ ও দেওয়ানী মোকদ্দমা চলে আসছিল। এরই জের ধরে গত ১০ মে সকালে স্থানীয় গোরস্থান সংলগ্ন শফিউল্লাহর স্বত্ব দখলীয় জমির ইরি-বোরো ধান আবু সালেহ ও তার লোকজন লাঠি সোটা নিয়ে কাটতে গেলে শফিউল্লাহ বাধা দেন। এতে তিনি প্রতিপক্ষের ধাওয়ার মুখে পিছু হটে নকলা থানায় ছুটে যান। ততক্ষণে আবু সালেহর নেতৃত্বে একদল লোক ধান কাটতে শুরু করলে শফিউল্লাহর ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ডলি খানম ডাক-চিৎকার দিয়ে বাঁধা দিতে গেলে আবু সালেহর হুকুমে তার ছোটভাই সলিমউল্লাহ, ভাইবউ লাখী আক্তারসহ অন্যান্যরা তাকে ঘেরাও করে ফেলে।
এক পর্যায়ে তার চোখে মুখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের ক্ষেতের আইলের থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের সাথে পেছনে হাত রেখে বেঁধে ফেলে। সেই সাথে পাশের অন্য গাছের সাথে টানা দিয়ে বেঁধে ফেলে তার দুই পা। এরপর যৌনাঙ্গসহ পেটে, বুকে, পিঠে কিল-ঘুষি-লাথির আঘাতে তাকে নিস্তেজ করে ফেলে। সেই সাথে ওই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে লাখী আক্তার। এ ঘটনা দেখে প্রতিবেশী একজন নির্যাতিতার স্বামী শফিউল্লাহকে ওই নির্যাতনের খবর জানাতে ছুটে যায় থানায়। পরে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর অবস্থায় ডলি খানমকে উদ্ধার এবং ঘটনায় জড়িত আবু সালেহ ও তার ছোট ভাই বউ লাখী আক্তারকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসার কথা বলে ডলিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানোর পর প্রভাবশালীদের তদবিরে ছাড়া পেয়ে যান আটক দুই জন।
অন্যদিকে বর্বর নির্যাতনে ডলি খানমের রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং তাকে ১৬ মে পর্যন্ত ৭ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পরও তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানেও ২২ মে পর্যন্ত ৭ দিন চলে তার চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, নির্যাতনের কারণে ডলি খানমের অকাল গর্ভপাত হয়েছে।
এই ঘটনায় অসহায় শফিউল্লাহ ৩ জুন শেরপুরের আমলী আদালতে আবু সালেহসহ ৫ জনকে ও আরও অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জনকে আসামি করে একটি নালিশী মামলা দায়ের করলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরীফুল ইসলাম খান ভিকটিমের এমসি তলব সাপেক্ষে ঘটনার বিষয়ে তদন্তপূর্বক ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য জামালপুরের পিবিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন।
মঙ্গলবার (১১ জুন) বিকেলে নির্যাতিতা গৃহবধূর স্বামী শফিউল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তার বড় ভাই নেছার উদ্দিনের ইন্ধনে তার স্ত্রী লাখী আক্তার এবং অপর দুই ভাই আবু সালেহ ও সলিমউল্লাহসহ তাদের ভাড়াটে লোকজন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ডলি খানমকে বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে গর্ভের সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া তার প্রভাবেই থানা পুলিশের এসআই ওমর ফারুক মহিলা কনস্টেবলসহ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ডলি খানমকে উদ্ধারের পরও কোন প্রতিকার পাইনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্যাতনের ভিডিওটিও থানাতেই গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক চেষ্টায় ঘটনার প্রায় এক মাস পরে হলেও সেই ভিডিওর কিছু অংশ এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।
এ সময় তিনি আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, এমন বর্বর নির্যাতনের পরও তারা আজ বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। আর আমি অসহায়। এজন্য আমি ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই।
বিষয়টি সম্পর্কে নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাহনেওয়াজ বলেন, জমি-জমার বিষয় নিয়ে ভাই-ভাইদের মধ্যে বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে দুই পক্ষকেই শান্ত করা হয়েছিল। গৃহবধূকে নির্যাতনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে জামালপুর পিবিআইয়ের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সীমা রাণী সরকার বলেন, মামলাটি এখনও হাতে পাইনি। পেলে অবশ্যই দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে বর্বরোচিত নির্যাতনের ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন…