সুসময়েরর পাখিরা উড়ে যায় চলে যায়

সমালোচনা সবাই সহ্য করতে পারেন না। মেনেও নিতে পারেন না। রাজনীতিবিদ হলে তো কথাই নেই। সাত দিন পক্ষে লিখলেন, একদিন বিপক্ষে গেলেই সর্বনাশ! আর রেহাই নেই। মাথা কাটা যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকশন। নেতাদের খুশি করা বড় কঠিন। আজকাল এসব নিয়ে ভাবি না। তবুও মাঝে মাঝে অনেক কিছু সামনে চলে আসে। আমি দেখেছি, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও লিখে তার সামনে যাওয়া যায়। কথাও বলা যায়। কখনো কখনো তিনিও জানতে চান সমস্যা কী? প্রবীণ সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর সমালোচক সাংবাদিকরা আগের দিন পত্রিকায় লিখতেন। পরের দিন সবাই দল বেঁধে যেতেন। বঙ্গবন্ধু রাগ রাগ ভাব নিয়ে থাকতেন। পরে পিঠ চাপড়িয়ে আদর করতেন। শেখ হাসিনাও অনেকটা তার বাবার মতো। কিন্তু আমাদের সুশীল নেতাদের বিরুদ্ধে বলা যায় না, ছোঁয়া যায় না। রাজনীতি করতে গিয়ে ভুল হতেই পারে। এই ভুল সংশোধন করে বেরিয়ে আসাই বড় কথা। মানুষ সব সঠিক করবে এই কথা ধর্মেও নেই। সমালোচনা সহ্য করতে না পারা নেতাদের বলছি, ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে শেখ হাসিনা লন্ডন ও ব্রাসেলস সফরে যান। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও আমি ওই সফরে ছিলাম। ব্রাসেলস থেকে আমি আবার সড়কপথে ফিরে আসি লন্ডনে। আড্ডায় আলাপের ভিত্তিতে সেই সফর নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশ হয় দৈনিক আজকের কাগজে। তাতে তখনকার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুদ্দিন খানের সমালোচনা ছিল। প্রশংসা ছিল সাবেক সভাপতি, ’৭৫-এর পরের দুঃসময়ের আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের। আমি সব সময় দুঃসময়ের কর্মীদের পক্ষেই থাকি। আমি লিখেছিলাম শামসুদ্দিন খান নেতা-কর্মীদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছেন না। এ কারণে অনেকে মনে করছেন, ভালোই ছিলেন আতা খান। এই লেখা প্রকাশের কয়েক দিন পরই সরকার থেকে বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়। গণভবন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে। তিনি আমাকে বললেন, তোমার এই রিপোর্ট লেখার কী দরকার ছিল? কণ্ঠস্বরে বড় বোনের মতো অনুশাসন। তার কাছে কারা যেন বলেছেন, আতা খানের রেস্টুরেন্টে বসে এ রিপোর্ট লিখেছি। আমি সেবার আতা খানের রেস্টুরেন্টে যাইনি। গিয়েছিলাম, তার কয়েক বছর আগে ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে। আমি একটা ব্যাখ্যা দিয়ে অন্য বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিলাম। তবে বললাম, লেখার আগে ছানু মিয়ার সঙ্গে দিলসাদ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। এই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। এর পর অন্য বিষয়ে কথা শুরু করলাম। তিনি নতুন বিষয় নিয়েই আলাপ শুরু করলেন। তার সামনে অনেক লোক। সবাই ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার মনোভাব কঠোর। আজ আমার খবর আছে। ’৯১ সালের ভোট থেকে টানা অনেক বছর আওয়ামী লীগ বিটের রিপোর্টার ছিলাম। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনেক রিপোর্ট করেছি। ড. কামাল হোসেনদের আওয়ামী লীগ ছাড়ার আগে বাড়াবাড়ি সব কিছুই ছিল। রিপোর্ট করে ধানমন্ডি ৩২ অথবা ২৯ মিন্টো রোডে যেতাম তিনি আমাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেন। ঢাকার বাইরে তার সঙ্গে সফরের সময় তিনি সফরসঙ্গী সব সাংবাদিকের খাওয়া থেকে শুরু করে সংবাদ পাঠানো পর্যন্ত সব খেয়াল রাখতেন। তার মাঝে এখানে বঙ্গবন্ধুর একটা ছায়া রয়ে গেছে। যার তুলনা তিনি নিজে, অন্য কেউ নন।

এর বিপরীতে জনপ্রিয় ধারার নেতাদের মাঝে আমি সহনশীলতা দেখি না। একজন মানুষের পক্ষে কোনো দিন লিখিনি তার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন। তার বিপক্ষে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছি। এমনকি তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের ধীরগতি নিয়ে সমালোচনা করেছি অনেক। পত্রিকা ছাড়াও টিভি টকশোতে তার সমালোচনামুখর ছিলাম আমরা। পদ্মা সেতুর আসল রহস্য বের হওয়ার পর একদিন শাহজালাল বিমানবন্দরে তার সঙ্গে দেখা। আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক একসঙ্গে। সবাই কম বেশি তার সমালোচক ছিলেন। আমরা তাকে দেখে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তিনিও আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই এগিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন সব সাংবাদিকের দিকে। কথা বললেন, সবার সঙ্গে। আমার দিকে হাসতে হাসতে বললেন, এখন সব প্রকল্প কি দ্রুত এগিয়ে চলছে? আমিও হাসলাম। আমাদের অনেক শ্রদ্ধাভাজনের সঙ্গে মিডিয়া অভিজ্ঞতা আজ আর লিখতে চাই না। তবে এটুকু বলছি, জোর করে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মিডিয়া তার গতিতে চলবেই। অনেক সময় আমরা অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সমালোচনা করেছি। জবাবে তিনি নিজেই মিডিয়া অফিসে ছুটে আসেন। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে বিদায় নেন। পরিবেশটাই বদলে দেন তিনি। বেশির ভাগ নেতা ক্ষমতার চেয়ারে থাকে একরূপ। চেয়ার না থাকলে আরেক রূপ। চেয়ার পাওয়ার পর অনেকের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। আপন পর মনে থাকে না। নিজের লোককে বানিয়ে দেন অন্য ঘরানার। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী সেই দিন এলেন অফিসে। কথায় কথায় বললেন, এক বড় আমলা তার ফোন ধরছেন না। প্রধানমন্ত্রী বলে দেওয়ার পরও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিস্মিত হলাম। মনে পড়ে গেল ’৯২ সালের একটি কথা। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তখন ঢাকা মেডিকেলে চক্ষু বিভাগের প্রধান। দেশের ক্ষমতায় বিএনপি। আমি কাজ করি ভোরের কাগজে। একদিন সন্ধ্যায় অফিসে এসে দেখি মোদাচ্ছের আলী আমাদের অফিসে। সৈয়দ বোরহান কবীর ও আমাকে তিনি জানালেন, জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছবি তিনি টানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলে নিজের কক্ষে। বিএনপির শাসনকালে সরকারি অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি। এ কাজটি মোদাচ্ছের আলীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। সেই সাহস ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি আবারও দেখিয়েছিলেন। যখন তখন তার অফিসে আমন্ত্রণ জানাতেন খেতে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তখন কারান্তরীণ। তিনি একাই শেখ হাসিনার মুক্তি ও ভোটের পক্ষে মিডিয়াতে বলে চলছেন। আমরা যেতাম। ফরিদাকেও কয়েকবার সঙ্গে নিয়েছিলাম। তিনি একদিন আমাকে বললেন, তোমাদের ডাকি এ কারণে মিডিয়ার ভাই ব্রাদাররা সঙ্গে থাকলে বুকে সাহস থাকে। কাউকে তোয়াক্কা করি না। সেই মোদাচ্ছের আলীর ফোন যে আমলারা ধরেন না তারা হয়তো জানেন না অনেক কিছু।

সুবিধাভোগী অতি দলবাজ আমলারা সবসময় সুসময়ের পাখি। এরশাদ আমলে যারা লাইম লাইটে ছিলেন পতনের পর তাদের খুঁজে পাননি সাবেক রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রীরা। ২০১৪ সালেই অনেকের চেহারা বদল হয়ে গিয়েছিল। একইভাবে বিএনপির শাসনকালে অনেকের বাড়াবাড়ি দেখেছি। সেই আমলারা এখন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের খোঁজও নেন না। বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছর আমলাদের এত আধিপত্য ছিল না। কিন্তু গত পাঁচ বছরে একদল আমলা নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক মনে করার চেষ্টা করছেন। এই মনে করাটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর, যা সাদা চোখে এখন বোঝা যাবে না। কিন্তু পরে ধরা পড়বে। সবার মনে রাখা উচিত আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। অন্য অনেক দলের মতো বহুমতের রাজনৈতিক ক্লাব নয়। ছাত্রলীগ করে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর কমিটমেন্ট আছে দীর্ঘ পথপরিক্রমায়। এর মাঝে কেউ ব্যুরোক্রেসিতে গেলে তাদেরও কমিটমেন্ট আছে। কিন্তু সুবিধাভোগীদের সেই কমিটমেন্টটুকু নেই। আর রাজনীতিবিদদের একটা জবাবদিহিতা আছে। তাদের জনগণের কাছে যেতে হয়। ভোট মোকাবিলা করতে হয়। আর একজন রাজনীতিবিদ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘরের সামনে কমপক্ষে ৫০ জন কর্মী অথবা সাহায্যপ্রার্থী দাঁড়িয়ে। বড় বড় আমলার কাছে কেউ যান না। গেলেও লাভ হয় না। এখনকার অনেক প্রভাবশালীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, চৌদ্দপুরুষের কেউ কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি। অনেকের ঘরবাড়িতে খোঁজ নিয়েও জেনেছি তিনি কিংবা তার পরিবারে কেউ কোনো দিন ছাত্রলীগও করেননি। কিন্তু এমন ভাব ধরে আছেন তারাই এখন আওয়ামী লীগের রক্ষাকর্তা। আওয়ামী লীগ নেতাদের, জনপ্রতিনিধিদের তারা গুরুত্ব দেন না। দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেন না। এখন সব ভালো। কোনো কারণে একটু খারাপ হলে সবারই চেহারা বদলে যাবে। আমি মনে করি, আমলাদের আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার দরকার নেই। আবার বিএনপি, জামায়াতও না। তাদের জনগণের সেবক হলেই চলে। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো সততা, নিষ্ঠা নিয়ে নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করলেই সমস্যা থাকে না। আর তা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে তারা তা করতে বাধ্য। তাই মাঠ পর্যায়ে অথবা ঢাকায় কর্মকর্তাদের আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সাজার চেষ্টা না করাই ভালো। সেদিন একজন বললেন, আপনারা সাংবাদিকরা দলবাজি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সবাই তো দলবাজ, সিভিল বা পুলিশ ব্যুরোক্রেসি জড়ালে সমস্যা কোথায়? আমি বললাম, এমন দৃশ্য দেখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে প্রশাসন সাজালেই হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের কাছে পেশাদারিত্ব আশা করি। দেশ ও জাতির স্বার্থেই তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হলে মানুষের যাওয়ার জায়গা থাকবে না। তাই দরকার কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্ট বাংলাদেশের সংবিধান, পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনকের প্রতি থাকলেই চলবে। ন্যূনতম পেশাদারিত্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই জরুরি।

দেশে এখন নতুন নতুন আওয়ামী লীগার দেখি। নিত্যনতুন পোশাক দেখি। ক্ষমতার দাপট দেখি। চেহারার পরিবর্তন দেখি। ত্যাগী পুরনোদের মুখ লুকানো দেখি। ভালোই লাগে, খারাপ না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সময়, স্রোত সবসময় এক রকম চলে না। আমাদের কোনো ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যেন ক্ষতি না হয়। সামাজিক গণমাধ্যমে আজকাল দেখি কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য লেখে। আবার কেউ কেউ অকারণে ধর্মকে নিয়েও উপহাস করে। ব্যক্তি আক্রমণের রেকর্ডও তৈরি হচ্ছে। ফেসবুকের এই অপব্যবহারের কথা অনুধাবন আগে করতে পারলে জুকারবার্গ এটা চালু করতেন কিনা জানি না। তবে এটুকু বলতে চাই, ধর্ম যার যার। কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে আক্রমণের ফ্যাশন কঠোরভাবে বন্ধ করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহঙ্কার। এই অহঙ্কার নিয়ে কটাক্ষের অধিকার কারও নেই। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এগিয়ে চলুক। আর এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন চিন্তার স্বাধীনতা।

পাদটীকা : ঢাকা শহরে দুটি বিষয় নজর কেড়েছে। প্রথমে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত সোনা হয়ে গেল পিতল। আর এ রহস্য বের করেছে সরকারের আরেকটি বিভাগ। শুল্ক গোয়েন্দাদের এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা গায়েবের এই ঝামেলা শেষ না হতেই দেখলাম মিরপুরে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়েছে পুলিশ। দুটি জিডির রেশ ধরে রীতিমতো খনন করে গুপ্তধন খোঁজা হয়। অন্যদিকে দিনাজপুরে বাতাসে মিলিয়ে গেল কয়লা। আগে শুনতাম কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। এখন দেখি কয়লা রাখলে তা আর যথাস্থানে থাকে না। এত কয়লা আসমানি বাতাসে গায়েব মনে করার কারণ নেই। এসব কল্পকাহিনী মানুষকে শুনিয়ে ছোটবেলার দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা সিরিজের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। তবে এই কাজে দস্যু বনহুর না রবিনহুড জড়িত তা বের করা দরকার।