বৃষ্টির শব্দে নেচে ওঠে মন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বৃষ্টির গান। বাংলা চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময়ের বেশ কিছু বৃষ্টির গান হয়েছে দর্শক নন্দিত। এ রকম পাঁচটি গান নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের এবারের প্রতিবেদন। গানের শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে বৃষ্টির গানের গল্প লিখেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক
আয় রে মেঘ আয় রে
চলচ্চিত্র: দ্য রেইন
শিল্পী: রুনা লায়লা
গীতিকার: গাজী মাজহারুল আনোয়ার
সুর: আনোয়ার পারভেজ
সঠিক সময়টা মনে করতে পারলেন না গাজী মাজহারুল আনোয়ার। শুধু বললেন, এ দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার পরপরই হবে। ওই সময় এস এম শফি দ্য রেইন ছবিটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর ধানমন্ডির বাসায় আলোচনা শুরু হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সংগীত পরিচালক ও সুরকার আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দিন আলী, নায়িকা অলিভিয়া এবং নায়ক ওয়াসিম। সেখানেই গানের দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেন এস এম শফি। সেই স্মৃতি হাতড়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ার বললেন, ‘একদিন শফি সাহেব আমাকে বললেন, “আমার বাসায় একটু আসেন, একসঙ্গে চা খাব।” আমি নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে গেলাম তাঁর ধানমন্ডির বাসায়। গিয়ে দেখি ছবির সবাই উপস্থিত। সবার সঙ্গে পরিচয় তো আগে থেকেই ছিল। তাই কুশলাদি বিনিময় করে কথা শুরু করলেন শফি সাহেব।’ কী সেই কথা? মাজহারুল আনোয়ারের ভাষায় ঠিক কথা নয়। গানের ব্যাপারটা বোঝানো। শফি সাহেব ওই দিন বোঝান—দ্য রেইন ছবির জন্য একটা গান হবে। যে গানে অনেক বেশি আবেগ থাকবে। আর গানটার মধ্যে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামা মানে দুজনের প্রেমটা গাঢ় হয়ে যাওয়া এবং কাছাকাছি আসা। মোটকথা একটা দারুণ জমজমাট প্রেমের মুহূর্ত তৈরি হবে।
মাজহারুল আনোয়ার ওখানেই বসে লিখে ফেলেন ‘আয় রে মেঘ আয় রে’ শিরোনামের দারুণ জনপ্রিয় গান। সেখানেই সুর করে ফেলেন আনোয়ার পারভেজ ও আলাউদ্দিন আলী। নায়িকা অলিভিয়াকেও বুঝিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে হবে দৃশ্যধারণ। কিন্তু গাইবে কে?
তত দিনে রুনা লায়লা বেশ জনপ্রিয়। তাঁকে দিয়েই গাওয়ানো হলো গানটি। আমরা রুনা লায়লার কাছে গানটির বাকি গল্প শুনতে গেলাম। রুনা লায়লা বললেন, ‘গানটি আমাকে গাইতে হবে জেনে ভালো লেগেছিল। কিন্তু গানটি যে এত জনপ্রিয় হবে সেটা আগে আমরা কেউই বুঝিনি। এফডিসিতে রেকর্ডিং করা হয়েছে। গাওয়ার পর সবাই বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।’ জানালেন এখনো বাইরে কোনো কনসার্টে গাইতে গেলে এই গানের অনুরোধ থাকেই। সেই অনুরোধ রাখেন।
বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে
চলচ্চিত্র: স্বপ্নের পৃথিবী
শিল্পী: সাবিনা ইয়াসমিন ও আগুন
গীতিকার: গাজী মাজহারুল আনোয়ার
সুরকার: আলাউদ্দিন আলী
তখন স্বপ্নের পৃথিবী ছবির শুটিং চলছিল। ছবির দুই অভিনয়শিল্পী সালমান শাহ ও শাবনূর শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। পরিচালক বাদল খন্দকার জানালেন আজ এই ছবির একটা গানের রেকর্ডিং হবে মগবাজারের শ্রুতি স্টুডিওতে। বলার সময় জানিয়ে রাখলেন ‘রোমান্টিক গান’। আর যায় কোথায়! বাদল খন্দকারের সঙ্গে রেকর্ডিং স্টুডিওতে হাজির দুই অভিনয়শিল্পী। সারা রাত ধরে চলল সেই রোমান্টিক গানের রেকর্ডিং। গানের শিরোনাম ‘বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে’। রেকর্ডিং শেষ করে ভোরের দিকে অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পীসহ সবাই বাড়ির পথ ধরেন। সেই সময়ের স্মৃতি মনে করে স্বপ্নের পৃথিবী চলচ্চিত্রের পরিচালক বাদল খন্দকার বললেন, ‘আমার সব ছবিতেই একটা বৃষ্টির গান রাখার চেষ্টা করি। এটাও তেমনই গান ছিল। গাজী ভাইকে বলার পর তিনি লিখে দিলেন। সুর করলেন আলাউদ্দিন ভাই। গাইতে এসে সাবিনা আপা ও আগুন মনপ্রাণ উজাড় করে গাইলেন। আর টানা ১২-১৩ দিন সেই গানের শুটিং হলো এফডিসি, কক্সবাজারসহ বেশ কিছু জায়গায়।’
গানের সুরকার আলাউদ্দিন আলী জানালেন, সুর করার সময় এত কিছু মাথায় ছিল না। কাজটা ঠিকঠাক করার পরিকল্পনা ছিল। পরে যখন গানটা সবার মুখে মুখে চলে এল তখন মনে হয়েছিল রাতভর পরিশ্রম সার্থক। সেই সার্থকতার কারণেই এখন বৃষ্টি নামলেই সবার আবেদন—বৃষ্টি রে বৃষ্টি আয় না জোরে।
চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
চলচ্চিত্র: আমার আছে জল
শিল্পী: হাবিব, সাবিনা ইয়াসমিন ও কণা
গীতিকার: হুমায়ূন আহমেদ
সুর: হুমায়ূন আহমেদ
আমার আছে জল ছবিটির শুটিং হয়েছে শ্রীমঙ্গলে। শুটিংয়ে যাওয়ার আগে গান প্রস্তুত করে নিয়ে গিয়েছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। গানটি গেয়েছিলেন হাবিব ও কণা ও সাবিনা ইয়াসমিন। গানটি নিয়ে কণার সঙ্গে কথা হয়। বললেন, ‘আমি গুলশানে হাবিব ভাইয়ের স্টুডিওতে গিয়েছিলাম গানটি গাওয়ার জন্য। গানটি কয়েকবার গাওয়ার পর ঠিক হলো। গানে কণ্ঠ দেওয়া শেষে হাবিব ভাই বললেন, “এটা কার গান জানো?” আমি “না” বলতেই তিনি বললেন, “এটা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের আমার আছে জল ছবির গান।” আমি তো থ! বললাম, আগে বলেন নাই কেন? হাবিব ভাই বললেন, “আগে জানলে যদি নার্ভাস হয়ে যাও। তাই বলিনি।’”
গানটির শুটিং নিয়ে কথা বললেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। ‘স্যার তো খুবই বৃষ্টি পছন্দ করতেন। আমরা শ্রীমঙ্গলে কৃত্রিম বৃষ্টির মধ্যে বেশ আনন্দ নিয়ে শুটিং করছিলাম। শুটিংয়ের মাঝামাঝি সময়ে সত্যিকারের বৃষ্টি নেমে এল। দুই বৃষ্টি মিলিয়ে চলল গানের শুটিং। গানের শুটিং শেষ হওয়ার পরও চলছিল বৃষ্টি। তখন ইউনিটের সবাই মিলে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। স্যারও ছিলেন সেই দলে।’
রুম ঝুম ঝুম বৃষ্টি
চলচ্চিত্র: জাগো
শিল্পী: কুমার বিশ্বজিৎ ও কণা
গীতিকার: ইশতিয়াক আহমেদ
সুর: অর্ণব
‘আমাদের ছবিতে একটা কমার্শিয়াল গান দরকার’। জাগো ছবির পরিচালক খিজির হায়াত খানের ভাবনা ছিল এমনই। কিন্তু কেমন হবে সেই গান? কী থাকবে গানে? তাই নিয়ে একদিন বসেছিলেন গীতিকার ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন সুরকার অর্ণব। পরিচালক ছবিটির গল্প বলেছিলেন। বিশেষ করে গানের দৃশ্যয়নটা। ইশতিয়াক আহমেদ লিখে ফেললেন গান। অর্ণবও সুর করলেন খুব ভেবেচিন্তে। কিন্তু গাইবে কে? খিজির হায়াত খান বললেন, ‘এটা ২০০৯ সালের কথা। ওই সময় বেশ চিন্তায় পড়েছিলাম কাকে দিয়ে গাওয়াব! দু-একজন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানো হলো গানটা। কিন্তু মনঃপূত হলো না। পরে কুমার বিশ্বজিৎ দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করি। দাদা গানটি গেয়ে দেন।’
গানের গল্পের বাকিটুকু বললেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। তাঁর সঙ্গে নাকি গানটি নিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন সংগীতশিল্পী অদিত। তাঁকে অর্ণবের স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন অদিতই। যখন নিয়ে গিয়েছিলেন তখন অর্ণব ছিলেন না স্টুডিওতে। পরে এসে যোগ দিয়েছিলেন গান রেকর্ডিংয়ের কর্মযজ্ঞে। এভাবেই জন্ম নিল বৃষ্টির গান ‘রুম ঝুম ঝুম বৃষ্টি’। গানটি নিয়ে কণা বললেন, গাওয়ার সময়ই বুঝেছিলাম এই গানটি সবাই খুব পছন্দ করবেন। বৃষ্টি হলেই শুনবেন এই গান। আমার ধারনা সত্যি হয়েছিল। নির্মাতা জানালেন, গানটির শুটিং হয়েছিল একটি রাজবাড়িতে।
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে
চলচ্চিত্র: নরম-গরম
শিল্পী: রুনা লায়লা
গীতিকার: আহমেদ জামান চৌধুরী
সুর: সুবল দাশ
গানটি নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে পারলেন না শিল্পী রুনা লায়লা। জানিয়ে রাখলেন, গানটি গাওয়ার সময় এত ভাবা হয়নি। তবে গানটি হিট হওয়ার পর ভালো লেগেছে। বললেন, ‘আগে তো অনেক গান গেয়েছি। তবুও একটা প্রস্তুতি ছিল। শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটা রেকর্ড করা হয়। আমি গিয়েছিলাম বিকেল বেলার দিকে। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়ে রেকর্ডিংয়ে ঢুকলাম। গাওয়ার পর সবাই বেশ খুশি হয়ে গেল।’
রুনা লায়লা জানালেন, গান ছবিতে ব্যবহারের পর বেশ সাড়া পড়ে যায়। এটা একটা বড় ব্যাপার। এই সাড়া পাওয়ার ব্যাপারটা তাঁর জন্য খুব আনন্দের ছিল। রুনা লায়লা বললেন, ‘ওই সময় বিটিভির অনুষ্ঠানে গানটি গেয়েছিলাম। এতে করে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল গানটি।’