পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে দেড় দশক ধরে চলছে সামন্তবাদী একঘেয়েমি, উৎকণ্ঠার রাজত্ব। পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনে দেশের ১৭ কোটি মানুষকে দিতে হচ্ছে ধৈর্যের পরীক্ষা। সকাল ১০টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন আর দেশের মানুষ তা জানতে পারে বেলা দুটোর পর। কেননা, শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন আর সেখানে তিনি জাতির সামনে কৈফিয়ত দেবেন। কী কৈফিয়ত তিনি এবার দিয়েছেন? এবার নাকি ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে’ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর তাই পাসের হার এবং জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রী এত দিনে ‘বিজ্ঞানসম্মত উত্তরপত্র পরীক্ষণের সূত্র’ আবিষ্কার করেছেন। আর তাতে জাতি নিশ্চয় ধন্য হয়েছে। কী সে পদ্ধতি? কেউ তা জানে না।
তাঁর আমলে শিক্ষার নামে দেশে পরীক্ষার মচ্ছব চলছে। বোল ফোটার আগেই পড়ুয়াকে বসতে হচ্ছে পরীক্ষায়। পরীক্ষা নামক দানবের খপ্পরে পড়ে লেখাপড়া লাটে উঠেছে, পড়ুয়ার নতুন নামকরণ হয়েছে পরীক্ষার্থী। দেশের সচেতন মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো মূল্য নেই; পরীক্ষার মোচ্ছব চলছেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আর লেখাপড়া জায়গা খুঁজে নিয়েছে কোচিং সেন্টারে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় দুটো লুটপাটের জায়গা এখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। দুটোতেই লুটেরাদের একাধিপত্য। সেটা সম্ভব করে দিয়েছে এই রাষ্ট্র। তারই সূত্র ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আপন ঘরে অনিরাপদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারাই।
এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে দেশের মানুষের উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রহসনের মধ্য দিয়ে। প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। তাই দুশ্চিন্তা ছিল সবার। কিন্তু বাহবা সরকার পেতেই পারে। উচ্চমাধ্যমিকে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ এবার অন্তত ছিল না। নির্বিঘ্নে পরীক্ষা নেওয়া গেছে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সুফল দিয়েছে। পরীক্ষার ফলে তার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু মন্ত্রী সেটা উল্লেখ করেননি। তিনি এর মধ্যে ‘বিজ্ঞান’ আবিষ্কার করেছেন। আমরা জানি, যে বিজ্ঞানের কথা মন্ত্রী বলেছেন, সেটা আমলাদের বানানো বার্তা। সেখানে কোনো অভিনবত্ব নেই। শুধু সরকারের একটা সিদ্ধান্ত আছে, পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরে সহানুভূতিসূচক ২/১ নম্বর দিয়ে পাস বা পরবর্তী গ্রেড পাইয়ে না দেওয়া। ফলে কেউ ৩২ পেলেও সহানুভূতির এক নম্বর না পেয়ে ফেল করেছে; আবার ৭৯ পেয়েও মাত্র এক নম্বরের জন্য ৮০ নম্বর না পেয়ে জিপিএ-৫ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। এভাবে প্রান্তক নম্বর সংশোধনের বহু পুরোনো নীতির অবসান ঘটেছে। সেটাও গত এক বছর কার্যকর হয়েছে। সুতরাং এ বছর তার নতুন কোনো তাৎপর্য নেই। কিন্তু মন্ত্রী সেটাই বললেন, মুখস্থবিদ্যার মতো।
আমরা যদি গত তিন বছরের সংখ্যাচিত্র পর্যালোচনা করি, তাহলে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব। যেমন ২০১৬ সালে গড় পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং এ বছর ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার গত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ কম। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ২৭৬, ২০১৭ সালে ৩৭ হাজার ৯৬৯ এবং এ বছর ২৯ হাজার ২৬২। দেখা যাচ্ছে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে এবং গত তিন বছরে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এর পেছনে কী কী কারণ ক্রিয়াশীল ছিল? প্রথমত, প্রশ্ন ফাঁস না হওয়া এবং দ্বিতীয়ত প্রাপ্ত প্রান্তক নম্বর সংশোধন না করা (অর্থাৎ ৭৯ নম্বর পেলে তা ৮০ না করা)। কিন্তু আরও নানা কারণ যুক্ত বলেই মনে হয়। যেমন যখন-তখন সিলেবাস সংশোধন, প্রশ্নের মান পুনর্বণ্টন, মূল বই পড়তে শিক্ষার্থীদের অনীহা, নোট-গাইডের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি আরোপ ইত্যাদি। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের প্রসঙ্গ কেন? কী সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি? একই উত্তরপত্র ফটোকপি করে ২০ থেকে ২৫ জন প্রধান পরীক্ষককে দিয়ে প্রথমে মূল্যায়ন করা; তারপর তা পর্যালোচনা করে একটি সমন্বিত নমুনা উত্তরমালা তৈরি করে নির্দেশনা প্রস্তুত করা? এটি শিক্ষা বোর্ডে বহু পুরোনো এক পদ্ধতি। সুতরাং উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষামন্ত্রীর কথিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অভিনবত্বের কিছুই নেই।
এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয় মানুষের নজর কেড়েছে। তার মধ্যে রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার কমে গড়ের কাছাকাছি (৬৬.৫১%) আসা। এই বোর্ডে পাসের উচ্চ হার দেশের গড় পাসের হারের চেয়ে সামঞ্জস্যহীনভাবে উঁচু (২০১৫ সালে ৭৭.৫৪%, ২০১৬ সালে ৭৫.৪০%, ২০১৭ সালে ৭১.৩০%) ছিল বলে গত কয়েক বছর সমালোচিত হয়ে আসছিল। এবার অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণে দেখা গেল, আগের সেই অবিশ্বাস্য উচ্চ পাসের হার কমে গেছে। এদিকে সিলেট বোর্ডেও একই ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘকাল যাবৎ এই দুই বোর্ডের পাসের হার নিয়ে সমালোচনা ছিল।
এবার ইংরেজির পাশাপাশি আইসিটি বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকে ফল খারাপের অন্যতম কারণ হিসেবে ইংরেজির পাশাপাশি আইসিটি প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে—এ কথা যেমন উঠেছে, পাশাপাশি আইসিটি শিক্ষকের অভাবের প্রসঙ্গটিও সামনে চলে এসেছে। সরকারি কলেজগুলোয় আইসিটি পাঠ চলছে গোঁজামিল দিয়ে। সেখানে আইসিটি শিক্ষক নিয়োগের কার্যকর উদ্যোগ নেই। আবার আইসিটি শিক্ষকের যে যোগ্যতা ধরা হয়েছে, তাতে এ বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতেও আগ্রহী নন। কেননা, সরকারি কলেজে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার চেয়ে অন্যত্র তাঁরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারি কলেজেই যদি আইসিটির উপযুক্ত শিক্ষক না পাওয়া যায়, বেসরকারি কলেজে তা পাওয়ার আশা করা বাতুলতা মাত্র।
দেশে স্কুল-কলেজগুলোয় লেখাপড়া লাটে উঠেছে। দুপুর ১২টার পর অনেক কলেজেই ছাত্রছাত্রীর দেখা মেলে না। তারা কোচিং সেন্টারে ছোটে। আর উঠে গেছে ব্যবহারিক ক্লাস। কয়টি কলেজে এখন বিজ্ঞান বিষয়গুলোর ব্যবহারিক ক্লাস হয়? পাবলিক পরীক্ষায় টাকা দিয়ে ব্যবহারিকে ফুল মার্ক পাওয়ার পাকা বন্দোবস্ত এখন সারা দেশে। নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ই এর প্রধান কারণ। সময় এসেছে এসব অনাসৃষ্টি থেকে জাতিকে উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার।
এবার দেশের ৫৫টি কলেজ থেকে একজনও পাস করেনি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই কলেজগুলো স্থাপিত হয়েছে কীভাবে? সেগুলো কি বোর্ডের অনুমোদন পেয়েছে? গত দুই দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন একটি লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। আর সে ব্যবসার পেছনে যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা। সাধারণভাবে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আসল হোতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেই তার স্বীকৃতি আদায় করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শর্ত শিথিল’ করে এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দিতে লোকগুলোকে বাধ্য করে। শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এসবের একটা বিহিত হওয়া দরকার।