ভেতরে রক্তাক্ত মা-মেয়ে, বাইরে ঝুলন্ত বাবা

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের হায়দরাবাদ এলাকায় শয়ন কক্ষে মা এবং মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়া মেয়ের রক্তাক্ত ও বারান্দা থেকে বাবার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে। মা ও মেয়ের গলা, মুখ পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

গতকাল বিকেল ৩টার দিকে জয়দেবপুর থানা পুলিশ নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ঘটনা জানাজানি হলে স্বজন, প্রতিবেশীসহ দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ বাড়িতে ভিড় জমায়। এ সময় স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ এবং জয়দেবপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, স্ত্রী ও মেয়েকে খুন করে স্বামী আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।

নিহতরা হলেন হায়দরাবাদ এলাকার আবুল হাশেমের ছেলে কামাল হোসেন (৪২), তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৭) ও তাঁদের একমাত্র সন্তান

সানজিদা কামাল ওরফে রিমি (১৮)। রিমি রাজধানীর উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

নিহত কামাল হোসেনের ভাবি মাহমুদা বেগম জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি সন্তানকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। কামাল হোসেনের বাড়ির কাছে আসার পর দেখতে পান বাইরের লাইট জ্বলছে। এত বেলা পর্যন্ত লাইট কেন জ্বলছে দেখার জন্য তিনি তাঁর বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখেন বারান্দায় গলায় রশি লাগানো কামাল হোসেনের লাশ ঝুলে আছে। ভেতর থেকে বারান্দার দরজায় তালা দেওয়া। পরে তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে পরিবারের অন্যদের ডাকাডাকি করার সময় নাজমা ও সানজিদাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। পরে থানায় খবর দেওয়া হলে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে।

জয়দেবপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ তিনটির সুরতহাল করেন। তিনি জানান, বারান্দাটি টিনের। চালের আড়ার সঙ্গে কামাল হোসেনের ঝুলন্ত লাশ। তাঁর শরীরে রক্ত লেগে রয়েছে। বাম হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘরে দুটি কক্ষ। মা-মেয়ের লাশ পূর্বদিকের রুমের মেঝেতে পড়ে ছিল। মা ও মেয়ের গলা, মুখ, পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের গভীর আঘাত রয়েছে। ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে আছে। লাশ দুটি পা থেকে পেট পর্যন্ত লেপ দিয়ে ঢাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে।

কামালের বড় ভাই দেলোয়ার হোসেন জানান, কামাল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা বাড়িতে থাকতেন। তাঁর ভাইয়ের আগে রেডিমেড কাপড়ের দোকান ছিল। বর্তমানে তিনি বেকার ছিলেন। ভাতিজি রিমি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন। পরে তাঁর ভাই জমি বিক্রি করে মেয়েকে ডাক্তার বানাতে উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেছিলেন। রিমি কলেজের হোস্টেলে থাকতেন। গতকাল তিনি মায়ের সঙ্গে বাসায় আসেন।

দেলোয়ার হোসেন আরো জানান, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে কারো শত্রুতা বা দ্বন্দ্ব ছিল না। কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জানা নেই। তিনি দাবি করেন, সকালে জানাজানির পর তাঁরা বাড়িতে গিয়ে বারান্দার দরজা ভেতর থেকে তালাবদ্ধ পেয়েছেন। তালা বাইরে থেকেও খোলা বা লাগানো যায়। তাঁদের ধারণা, ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েকে দুর্বত্তরা খুন করে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তাঁর ভাইকেও হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখে গেছে।

বৃদ্ধ বাবা আবুল হাশেম জানান, তাঁর ছেলে কিছুতেই এ কাজ করতে পারে না। তা ছাড়া তিনি কেন আদরের একমাত্র মেয়েকে এবং স্ত্রীকে খুন করতে যাবেন। খুব সুখের সংসার ছিল তাঁদের। দুর্বৃৃত্তরা তাঁদের খুন করেছে। তিনি খুনিদের গ্রেপ্তার এবং ছেলে, পুত্রবধূ ও নানতির হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক প্রতিবেশী জানায়, কামালের বাড়ির গেট সব সময় বন্ধ থাকত। আশপাশের কারো তেমন যাতায়াত ছিল না ওই বাড়িতে। তবে কখনো তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে শোনেনি। তবে বেশ কিছুদিন ধরে কামাল ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রায়ই রাতে বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে ইয়াবা সেবন করতেন তিনি। বুধবার রাতেও তাঁর বাড়িতে লোকজন এসেছে এবং তাদের জন্য বিশেষ রান্না হয়েছে বলেও তারা শুনেছে। নেশায় আসক্ত হয়ে কামালের বন্ধুদের কুদৃষ্টি দেওয়ার জেরে মা-মেয়েকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। বাধা দিতে গিয়ে বাবাকে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়ে থাকতে পারে। কারণ কামালের একার পক্ষে দুজনকে ছুরিকাঘাত করে খুন করা সম্ভব নয়।

জয়দেবপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, মা-মেয়ের গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের অনেক আঘাত রয়েছে। আঘাত দেখে মনে হচ্ছে খুনি প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে তাঁদের খুন করেছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ বলেন, ‘বাবার ঝুলন্ত লাশের পাশের একটি চেয়ার থেকে রক্ত ও চুলমাখা একটি চাকু উদ্ধার হয়েছে। পাশের টেবিলে একটি কোরআন শরিফ এবং অনেক সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষোভ বা বিকারগ্রস্ত হয়ে কামাল হোসেন ঘুমন্ত স্ত্রী ও মেয়েকে খুন করে নিজে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে তিনি সিগারেটগুলো খেয়েছেন। ঘটনার পেছনে অন্য কেউ বা কারণও থাকতে পারে। আমরা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। ওই সব উত্তর পাওয়া গেলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।’