গ্রামটির নাম নারকিলা। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার এই গ্রাম থেকে এবারই প্রথম কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করল। গর্বিত এই ছাত্রের নাম পাবেল মিয়া। সে দিরাই ডিগ্রি কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৮০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার এই কৃতিত্বে পরিবারের পাশাপাশি গ্রামবাসীর মধ্যে আনন্দের হল্লা বইছে। তাদের আশা, এবার হয়তো গ্রামটির অতীত দুর্নামও ঘুচবে। অনেকের কাছে গ্রামটির পরিচিতি ‘চোরাপল্লী’ হিসেবে।
পাবেলের দরিদ্র পরিবার তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি দুশ্চিন্তায়ও পড়েছে সামনে তার শিক্ষার খরচ জোগানো নিয়ে। সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা শাল্লা হবিবপুর ইউনিয়নের দুর্গমে সুবিধাবঞ্চিত এই নারকিলা গ্রামের অবস্থান। এর পশ্চিমাংশে বর্তমানে ৬০টি
পরিবারের প্রায় সহস্রাধিক মানুষের বসবাস। শোনা যায়, বংশানুক্রমিকভাবে এসব পরিবার একসময় চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় গ্রামের অনেকে ভোটার তালিকায় পেশা হিসেবে ‘চোর’ লিখতে চাওয়ায় দেশে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তারা এখন আর সেই পেশায় নেই। তবে সামাজিকভাবে আজও তারা অবহেলা ও বঞ্চনার মধ্যে রয়েছে।
গ্রামটি কয়েক শ বছরের পুরনো হলেও এখনো কোনো স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত গ্রামবাসী। খুপরিঘরে তাদের বসবাস। বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বা বেসরকারি কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্প আজও নেওয়া হয়নি গ্রামটিতে। দিনমজুরি, গার্মেন্ট ও পাথরকোয়ারিতে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে গ্রামের বাসিন্দারা। বেশির ভাগ মানুষই দিনমজুর।
এই গ্রামেরই হতদিরদ্র আব্দুর রহমানের বড় ছেলে পাবেল মিয়া। বাবা খরচ জোগাতে না পেরে একাধিকবার ছেলের পড়ালেখা বন্ধ করিয়েছিলেন। কিন্তু হার মানেনি পাবেল। নিজে শ্রমিকের কাজ করে পড়ালেখা চালিয়েছে। আর এই কঠিন সংগ্রামের ফলে সে এখন গ্রামের প্রথম এসএসসি ও এইচএসসি পাস যুবক। পাবেল শাল্লা উপজেলার শ্যামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (বিজ্ঞান) ৩.২০ জিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। অর্থের অভাবে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায়নি। এখন এই অভাবী ছাত্র স্বপ্ন দেখছে প্রকৌশলী হওয়ার। তবে বাবার সাধ্য নেই ছেলের ইচ্ছা পূর্ণ করার। জানা গেছে, পাবেলকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনায় বই-খাতা ও আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সুনামগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার মো. হারুনুর রশিদ ও বর্তমান পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান।
আব্দুর রহমানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ছেলেদের মধ্যে সবার বড় পাবেল। তার বাবা দিনমজুরি করে সংসার চালান। পড়ালেখার পাশাপাশি পাবেল নিজেও শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন সময় কাজ করেছে। তার ছোট দুই ভাইও পড়ালেখা করছে। পাবেল এখন অনার্সে ভর্তির জন্য জেলা শহরে গিয়ে লজিং থেকে পড়ালেখা করছে। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার পাবেল নিজ গ্রামবাসীর মধ্যে সচেতনতামূলক কাজও করছে। গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মাদক কারবারিরা তাদের মাধ্যমে চোলাই মদ তৈরি করে বাজারজাত করে বলেও অভিযোগ আছে। পাবেল গত মাসে এর বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে মারধর করেছিল মাদক কারবারিরা। পড়ালেখার মাধ্যমে নিজের স্বপ্নপূরণের পাশপাশি নিজের অবহেলিত গ্রামবাসীর ভাগ্যোন্নয়নেরও স্বপ্ন দেখছে পাবেল।
কালের কণ্ঠকে পাবেল বলে, ‘আমাদের গ্রামের গোষ্ঠীর লোকদের এলাকাবাসী আজীবন ঘৃণা করে। গ্রামের মানুষ বহু আগেই ভালো হয়ে গেলেও এখনো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিলে তারা আমাদের বদনাম করে। এ কারণে অনেকেরই শিক্ষাজীবন বিদ্যালয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমি এসব গায়ে মাখিনি। আমি দরিদ্রতার মধ্যেও স্বাভাবিক পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। জানি না আর্থিক অবস্থা শেষ পর্যন্ত আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে।’
দিরাই ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘পাবেল মিয়া খুব শান্তশিষ্ট ও নিরীহ ছাত্র। আমরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছি। শুধু বোর্ড নির্ধারিত ফি বাদে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু নিইনি। একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা এই শিক্ষার্থী যেভাবে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছে, আশা করি তার স্বপ্ন পূরণ হবে। তবে বিত্তবান লোকজন তাকে সহযোগিতা করলে তার স্বপ্নপূরণ সহজ হবে। কারণ তার পিতার কোনো সাধ্য নেই ছেলেকে পড়ালেখা করানোর।’ শাল্লা উপজেলার সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক পিযুষ দাস বলেন, ‘পাবেল অবহেলিত নারকিলা গ্রামের প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস যুবক। সংগ্রাম করে দারিদ্র্যের কাছে হার না মেনে সে নানা সমস্যার মধ্যেও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার।’–কালের কন্ঠ