মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্তে বদলে যেতে পারে মালয়েশিয়া যাওয়া শ্রমিকদের ভাগ্য। বর্তমান বাজারের চেয়ে অনেক কম টাকায় কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া মাত্র এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়া সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকার এক চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন দিয়েছে। গাইডলাইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক মাঠ পর্যায়ের নির্ধারিত ব্যাংকের শাখায় জমা দিবেন এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। পরে মন্ত্রণালয় এ অর্থ থেকে এজেন্সি কমিশন, বায়রা, মালয়েশিয়া সরকারের ফি, বিমান ভাড়া, মেডিকেল ফিসহ সব কিছুই যার যার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে পরিশোধ করবে। এতে শ্রমিকরা হয়রানিমুক্ত ভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে যেতে পারবেন, অন্যদিকে দালাল বা তৃতীয় কোনো মহলের উৎপাত থাকবে না। বাড়তি কোনো টাকাও দিতে হবে না ঘাটে ঘাটে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে মালয়েশিয়া সরকারের এ প্রস্তাব পড়ে আছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। অজ্ঞাত কারণে আটকে আছে বাস্তবায়ন।
মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৬ নভেম্বর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা (পাসপোর্ট ফি ও প্রশিক্ষণ ফি ছাড়া) নির্ধারণ এবং ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণের সিদ্ধান্তকে মালয়েশিয়া স্বাগত জানাচ্ছে এবং প্রশংসা করছে। বায়ো-রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্ধারিত অর্থ দিয়েই কর্মীরা যেন মালয়েশিয়া যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সিস্টেম প্রোভাইডার ও ব্যাংকগুলো একসঙ্গে কাজ করবে। মালয়েশিয়ার তৎকালীন মানব সম্পদ মন্ত্রী দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ট আনাক জায়েম মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে এই চিঠি পাঠান। তিনি এই চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ২০১৭ সালের ১৫ জুন মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী বরাবর বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর চিঠি, ২৫ আগস্ট দেওয়া মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জবাব এবং ২০১৭ এর ১৬ অক্টোবর ঢাকায় মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও মানবসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বৈঠকের পরিপ্র্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে। জানা যায়, নতুন আদেশ অনুযায়ী, বিদেশগামী কর্মীর কাছ থেকে সার্ভিস চার্জসহ পুরো অর্থই চেক বা ব্যাংক ড্রাফট অথবা পে-অর্ডারের মাধ্যমে নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবে। ব্যাংকিং রীতি অনুসারে, বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীকে প্রাপ্তি স্বীকার রসিদ দিবে ব্যাংক। সেখান থেকেই সব খাতে খরচের অর্থ পৌঁছে যাবে ব্যাংকিং সিস্টেমেই। নির্ধারিত অঙ্কের বাইরে কোনো এজেন্সি অর্থ গ্রহণ করলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, আগে শুধু দুই সরকারের মধ্যে পরিচালিত ‘জি টু জি’ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় অভিবাসনের ব্যয় ছিল জনপ্রতি ৩৭ হাজার ৫৭৫ টাকা। পরবর্তীতে দুই দেশের বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নিয়ে শুরু হওয়া ‘জি টু জি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাস্তবতা বিবেচনায় ব্যয় নির্ধারণের প্রয়োজন হয়। কারণ যেখানে ৩৪ হাজার টাকার কাছাকাছি বিমানভাড়া সেখানে ৩৭ হাজারে কর্মী পাঠানো অসম্ভব বলে বরাবরই জানায় এজেন্সিগুলো। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জের বাস্তবতা। তাই এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগও আসছিল। এমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ার কর্মী প্রেরণকে সুষ্ঠু করতে এবং বাস্তবের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি বিবেচনায় নিয়েই সর্বোচ্চ ব্যয় সীমা অনুসারে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এ সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া- দুই দেশের সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়। গত বছরের ১৪ জুন মালয়েশিয়া ও অন্য আরও ১৩টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা অভিবাসন ব্যয়সীমা বেঁধে দিয়ে সরকারি আদেশ জারি করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশগুলোয় একজন কর্মীর তিন-পাঁচ মাসের বেতনের সমপরিমাণ অর্থকে সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আদেশ জারির পরদিন ১৫ জুন সেই সিদ্ধান্তই চিঠি দিয়ে জানানো হয় মালয়েশিয়াকে। পরবর্তীতে দুই দফার আলোচনায় জনশক্তি আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রতারণা মুক্ত রাখতে ব্যাংকে অর্থ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশে নির্ধারণ করে দেওয়া ১০ এজেন্সি যেন কোনো রকমের দুর্নীতি বা প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করতে পারে সেজন্যই এ সিদ্ধান্ত।
জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, মালয়েশিয়া ছাড়া অন্য যে ১৩ দেশে কর্মী প্রেরণের সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয়সীমা বেঁধে দেওয়ার আদেশ জারি করা হয় সেগুলো সেদিনই বাস্তবায়ন হয়। এর মধ্যে রয়েছে লিবিয়া, বাহরাইন, আরব-আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, কাতার, জর্ডান, মিসর, রাশিয়া, মালদ্বীপ, ব্রুণাই ও লেবানন। কিন্তু মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে আদেশ জারি এবং দুই দেশের মন্ত্রীদের লিখিত চিঠির ঘোষণার পরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন আটকে থাকার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দুষছেন রপ্তানিকারকরা। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার জি টু জি প্লাস চুক্তিতে ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে পরবর্তী ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে কর্মকর্তাদের আলোচনার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে নতুন নির্ধারণ অভিবাসন ব্যয় ও পদ্ধতির দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। কারণ নতুন নিয়মে যখন ব্যাংকে টাকা নিলে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের সুযোগ থাকবে না। কর্মীদের প্রতারিত করতে পারবে না দালাল চক্রও। তিনি বলেন, তখন মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পদ্ধতি অন্য সব ক্ষেত্রেই আদর্শ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ ইতিমধ্যেই শ্রমবাজার প্রতারণামুক্ত রাখতে নিয়োগকর্তাদের দেওয়া চাহিদাপত্র সত্যায়নের কাজ করছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। চাহিদাপত্রে উল্লেখ করা বিষয়গুলো নিরীক্ষা করে দেখতে হাইকমিশনের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে যাচ্ছেন ফ্যাক্টরি, কারখানা ও নির্মাণ কোম্পানিতে। তারা সেখানে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক, কর্মীদের সাক্ষাৎকার, কর্মস্থল ও হোটেল পরিদর্শন এবং নতুন কর্মী নিয়োগ করার সুযোগ, থাকার সুব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, ওভার টাইম, বেতন ব্যাংকের মাধ্যমে দেয় কি না, বিদ্যমান কর্মীদেও পে স্লিপ চেক করা, কোম্পানির আয়-ব্যয়, শেয়ার, লাইসেন্স, উৎপাদন, এক্সপোর্ট ইত্যাদি সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে চাহিদাপত্র সত্যায়িত করছে হাইকমিশন। এ কারণে এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া যাওয়া দুই লক্ষাধিক কর্মীর কারও পক্ষ থেকেই প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ আসেনি। এখন ঢাকায় ব্যাংকিং সিস্টেমে অর্থ জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারলে জনশক্তি প্রেরণের পুরো প্রক্রিয়াটিই হবে স্বচ্ছ ও প্রতারণা মুক্ত।