আফিয়ার বয়স এখন ১৮ মাস। গত ১৫ মাস ধরেই সে রয়েছে কারাগারে। তার বাবা-মা জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বন্দী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আফিয়ার মা আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ তাকে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু দুধের শিশু আফিয়া থাকবে কোথায়? আদালত সিদ্ধান্ত দেন, শিশুটি মায়ের সঙ্গেই থাকবে। সেই থেকে আফিয়া কারাগারে।
তখন আফিয়ার বয়স ছিল মাত্র আড়াই মাস। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৫ মাস। আফিয়া জেলেই রয়েছে। সেখানে চরম অনাদারে তার দিন কাটছে। এই বয়সী শিশুদের জন্য বাড়তি যে যত্ম প্রয়োজন তার কিছুই পায় না আফিয়া। তার জন্য কারাগার থেকে শুধু দুধ আর চিনি বরাদ্দ থাকে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আফিয়ার জন্মের আগেই তার বাবা জহুরুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। জহুরুলের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের দিয়াড় মানিকচক গ্রামে। স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর একই উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুর গ্রামে বাবা সাজ্জাদ হোসেনের বাড়িতে থাকতেন আফিয়ার মা সুমাইয়া খাতুন।
গত বছরের ১১ মে সেই বাড়িতে ‘সান ডেভিল’ নামে এক অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে অভিযানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মারা যান সুমাইয়ার বাবা, মা, ভাই, বোন ও আরও একজন। তাদের হামলায় মারা যান দমকল বাহিনীরও এক কর্মী।
ঘটনার পর নিজের দুই সন্তান আড়াই মাসের আফিয়া ও ৮ বছরের জুবায়েরকে নিয়ে মাঠের মধ্যে বসে থাকেন সুমাইয়া। তিন ঘণ্টা পর তিনি আত্মসমর্পণ করেন। পরে তাকে আদালতে তোলা হয়। আদালত তার শিশু আফিয়াকে কারাগারে সঙ্গে রাখার অনুমতি দেন। আর জুবায়েরকে দেওয়া হয় স্বজনদের হেফাজতে।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন বলছিলেন, যেসব হাজতি নারীদের সঙ্গে বাচ্চা থাকে তাদের আলাদা একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়। সুমাইয়াকেও সেভাবে রাখা হয়েছে। অন্য হাজতিদের জন্য যে খাবার বরাদ্দ থাকে সুমাইয়াও তাই পান। তবে শিশুটির জন্য কারাগারের পক্ষ থেকে শুধু দুধ আর চিনি দেওয়া হয়।
নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) নির্বাহী পরিচালক সালিমা সারোয়ার বলেন, ‘জঙ্গিরা পরিবার কিংবা সন্তানের কথা ভাবে না। সুমাইয়াও নিশ্চয় ভাবেনি। তাই তার সঙ্গে এখন সন্তানকে কারাগারে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এতে শিশুটিরই ক্ষতি হচ্ছে।’
‘কারাগারে শিশুটির সঠিক শারীরিক বিকাশ হবে না। কেননা, শিশুর জন্য বাড়তি যতœ দরকার। সে বিষয়টি কারাগারে একেবারেই নজরে নেওয়া হয় না।’
জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইবরাহিম হোসেন বলেন, ‘মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য খুব দরকার। তাই একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের কারাবন্দী মায়ের সঙ্গে রাখার বিধান রয়েছে। এই বিধানের বলেই সুমাইয়ার সঙ্গে তার শিশু সন্তান রয়েছে। যদিও হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করেছেন যে, কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। কিন্তু এটি এখনও কার্যকর হয়নি। তবে বর্তমান আইনে সাত বছর বয়স হওয়ার পরও মায়ের মুক্তি না মিললে শিশুটিকে আর কারাগারে রাখা যাবে না।’
রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘জঙ্গি আস্তানা থেকে বের হয়ে আসা শিশুদের মেডিক্যালের ভাষায় ফোবিয়া ও ইউলিশন হতে পারে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বধিরতা দেখা দিতে পারে। এমনকি তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। এ জন্য এখন তাদের ভালো পরিবেশে রাখতে হবে। সঠিক চিকিৎসা করাতে হবে।’
মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আজম তৌহিদ বলেন, ‘জঙ্গিবাদে জড়ানোর আগে তার বাবা-মা এসব চিন্তা করেনি। এগুলো চিন্তা করলে তারা জঙ্গিবাদে জড়াতে পারতেন না। নিষ্পাপ শিশুকেও তাহলে জেল খাটতে হতো না।’