টাইমবোমার ওপরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

চার দশকেরও আগের কথা। আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন তরুণ অফিসার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যে আকস্মিক অনেক বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশ এক ঘোর অনিশ্চয়তায় নিপতিত হয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাত্ক্ষণিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে গণচীন। ত্বরিত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে আস্থা দেয় এবং ভরসার জায়গাটা শক্ত করে। তখন আমি ঢাকা সেনানিবাসের এক ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটের অধিনায়ক। আমার মনে পড়ে সেনাসদরে সিজিএস জেনারেল এম এ মঞ্জুর আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে বললেন আপনি পাকিস্তানে চীনা ভাষা পড়েছিলেন। কিছু কি মনে আছে? আমি বললাম সে তো অনেক দিন আগের কথা। কোর্স শেষ না হতেই যুদ্ধ বেধে গেল। আর তারপর তো আমরা বন্দী হয়ে গেলাম। তবুও নিশ্চয়ই অনেক কিছু মনে আছে। তিনি আমাকে বললেন, আপনি আবার চীনে যাবেন, চীনা ভাষা পড়াটা সম্পন্ন করতে। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন।

পিকিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে (এখন ইউনিভার্সিটি) আমি চীনা ভাষা পড়াশোনা করছি। আমাদের ক্লাসে ছিল ভিক্টর নামে এক সহপাঠী। ভেনেজুয়েলায় বাড়ি। বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার অসীম কৌতূহল। অনেক কিছু জানতে চায়। একদিন আমার রুমে এসে বাংলাদেশের অনেক ছবি দেয়ালে টাঙানো দেখে খুশি হয়ে বলে তোমার দেশটা তো ভারি সুন্দর, শুধু নদ-নদী, গাছপালা। ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা শ্যামলে শ্যামল সবুজে সবুজ নীলিমায় নীল তোমার দেশ। সে জিজ্ঞাসা করে তোমার দেশটা কত বড় কত তার আয়তন। আমি বলি পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল। সে মাইলের হিসাব বোঝে না। সে সঙ্গে সঙ্গে কলম হাতে নিয়ে স্কয়ার কিলোমিটারে কনভার্সন করে বলে তোমার দেশটা এত ছোট। লোকসংখ্যা জানতে চাইলে আমি বলি সাড়ে সাত কোটি। সে কোটি বোঝে না ব্যাখ্যা করে বলি ৭৫ মিলিয়ন। ১৯৭৬ সালের কথা তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনই ছিল। সে কপালে হাত দিয়ে বলে তুমি কি সত্যি বলছ? আমি বলি হ্যাঁ। সে বলে না, এ অসম্ভব।

আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। ছিয়াত্তর সালের লোকসংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের দেশের আয়তন যা ছিল তাই রয়ে গেছে। বরং পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সমুদ্রের জলস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের স্থলসীমা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। দক্ষিণে উপকূলের অনেক অঞ্চল তলিয়ে গেছে। জনসংখ্যা ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এক হাজার ১২০ জনের বাস। ওপরের দেশগুলো ম্যাকাও, সিঙ্গাপুর, হংকং, জিব্রাল্টার (ইউকে), ভ্যাটিকান সিটি, মাল্টা, বারমুডা। দেশগুলো সবই নগর রাষ্ট্র। মাল্টা ও বারমুডা নগর রাষ্ট্র না হলেও দ্বীপ রাষ্ট্র, যারা পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। পর্যটন কেন্দ্রিক দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। বাংলাদেশ কোনো নগর রাষ্ট্র নয়। দ্বীপ কেন্দ্রিক পর্যটন রাষ্ট্রও নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে চীন ও ভারতে। যাদের জনসংখ্যা যথাক্রমে ১৩৪ কোটি ও ১২০ কোটি। অথচ তাদের দেশের জনঘনত্ব মাত্র যথাক্রমে ১৩৯ ও ৩৬২ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে। যদি বাংলাদেশের সমান জনঘনত্ব চীন ও ভারতে হতো তাহলে তাদের দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াত যথাক্রমে ১৮৫.৫ কোটি ও ৩৭৩ কোটি। দেশে জনসংখ্যার নেতিবাচক চাপ পড়ছে সব খাত ও পুরো দেশের জনজীবনে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতাসহ নানা জটিল সমস্যা। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। বয়স, যোগ্যতা, দক্ষতা অনুযায়ী জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় নেই সরকারের আধুনিক ও বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। নেই জাতীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার নীতিমালা। দেশে যে দিকে তাকাও চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে দেশে প্রতি ১১ সেকেন্ডে জন্মায় একটি শিশু। পাঁচ বছর ধরে বছরে ৩২ লাখের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জনসংখ্যা এখন কত এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও কারও কাছে নেই। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১০ সালে বলা হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ২৫ হাজার। জনসংখ্যাবিষয়ক গবেষকরা তখনই এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জনসংখ্যার আকার বেড়ে যাওয়ায় সবক্ষেত্রে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। এর গতিরোধ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশটি বসবাস ও শাসনের অযোগ্য হয়ে যাবে। একটা সময় হয়তো শুধু নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটিই মুখ্য ছিল। এখন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। নয়তো জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ব্যাপারটা নিছক স্লোগানের মধ্যেই আটকে থাকবে। বাংলাদেশে যে সত্যিকার অর্থে জনবিস্ফোরণ ঘটছে তা আর কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই।

আশির দশকেই বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের তৃতীয় পর্যায় প্রবেশ করেছে। অবশ্য বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ১.৩ শতাংশ নেমে গেছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘের জনসংখ্যা সম্পর্কিত সংস্থা ইউএনএফপিএর জরিপ মোতাবেক তা এখন ১.৪২ শতাংশে রয়ে গেছে। এ দেশে মোট প্রজনন হার সত্তর দশকে ছিল ৬। এই হার কমে এখন ২.৩ এ দাঁড়িয়েছে। এটাকে ২-এর অনেক নিচে নামাতেই হবে, যদি আমরা জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে নামাতে চাই। এর অন্যথা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মোমেনটামের ফলে ২০৩০ সালের পরেও এ দেশের জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। (পপুলেশন মোমেনটাম বজায় থাকার মূল কারণ, শিশুদের সম্ভাব্য পিতা-মাতারা ৩০, ৪০, ৫০ বছর আগেই জন্ম নিয়েছেন)। এই হার না কমার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাল্যবিবাহ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে সবার ওপরে। সরকার শতপ্রোণদিত হয়ে নারীর ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ থেকে কমিয়ে বিশেষ ক্ষেত্রে ১৬ করেছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। ১৮ বছরেই থাকুক আইনগতভাবে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স। কোনো অবস্থাতেই কোনো বিশেষ অবস্থার সুযোগ আইনে রাখা চলবে না। রাখলে সমাজের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ও নিম্নবিত্ত কৃষক-শ্রমিক পিতা-মাতার জন্য ওই বিশেষ ব্যবস্থাই ‘আইনি নিয়মে’ পর্যবসিত হবে।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র মানুষের যে বিপুল সমাগম দেখা যায়, পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে তা কখনো দেখা যায় না। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে জেগে ওঠা চরে যেখানে বসবাস করার ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই সেখানেও বাস করছে হাজার হাজার মানুষ। সেখানে নেই কোনো সুপেয় পানি, স্বাস্থ্য, পরিসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট—কিছুই নেই। মানুষ যে কীভাবে সেখানে বসবাস করে তা স্বচক্ষে না দেখলে কারও বিশ্বাস হবে না। যদি কোনো ঘূর্ণিঝড় সেসব অঞ্চলে আঘাত হানে, মানুষ সেখানে অকাতরে মারা যায় মশা-মাছির মতো। মানুষের জীবনের কোনো কানা-কড়িও মূল্য নেই তা বোঝা যায় এসব জায়গায় গেলে। প্রশ্ন হলো কেন এহেন দুর্গম অঞ্চলে মানুষ বসবাস করছে? উত্তর হলো এদের বসবাসের জন্য বিশাল ধরিত্রিতে কোনো জায়গা নেই। এ বিরাট পৃথিবীতে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে জীবন ধারণের স্থান তাদের নেই। আর তাই জীবনের মহা ঝুঁকি নিয়ে এসব প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বসবাস করে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। ঢাকার মধ্যে বিশেষ করে রেললাইনের পাশে যেভাবে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করে, তাদের নেই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানি। দেখা যায় যেসব জায়গায় ময়লা জমাট করে নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে তার পাশেই মানুষ বস্তিঘর বেঁধে ভয়াবহ দুর্গন্ধের মধ্যে বসবাস করছে। দেখা যায় দুর্গন্ধ এতটাই প্রকট যে, বেওয়ারিশ কুকুর পর্যন্ত সেখানে যায় না। অথচ মানুষ দিব্যি সেখানে বসবাস করছে। এর চাইতে আর বেশি কীভাবে মানুষ অপমানিত, হীন ও লাঞ্ছিত হতে পারে। জন ঘনত্বের চাপ ঢাকা নগরীতে এতটাই ভয়াবহ আর মারাত্মক যে, রাজপথের দুধারে যে ফুটপাথ আছে তা গভীর রাত পর্যন্ত জনস্রোতে প্লাবিত। ফুটপাথ দিয়ে যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। এ ছাড়া গভীর রাত পর্যন্ত গোটা নগরী ভয়াবহ যানজটে আটকে থাকে। যে নগরীতে বড়জোর ৩০ লাখ লোক কোনোমতে বসবাস করতে পারে, সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করছে ১ কোটি ৩০ লাখ লোক, মানে বাড়তি ১ কোটি লোক ঢাকা নগরীতে বসবাস করে। এ ছাড়া প্রতিদিনই এ নগরীতে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক আসে, তারা কাজ শেষে ফিরে যায়। অর্থাৎ ১ কোটি ৩০ লাখ অতিরিক্ত লোক প্রতিদিন ঢাকা নগরীতে চাপ প্রয়োগ করছে। এ অতিরিক্ত লোকের জন্য নেই থাকার ঘর, রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য পরিসেবা, খাবার পানি। উপরন্তু এরা ৩০ লাখ লোকের জন্য বরাদ্দ সবকিছুতে ভাগ বসিয়ে তাদের জীবনটাও দুর্বিষহ করে তুলছে। যে কারণে ঢাকা মহানগরী এখন পৃথিবীর সবচাইতে বসবাস অযোগ্য একটা নিকৃষ্ট নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জনসংখ্যার এত ঘনত্বের কারণে ঢাকায় নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। উপচে পড়া মানুষের কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, বর্জ্য অপসারণ, পরিবহন, যানজট, পয়ঃনিষ্কাশন, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে নগরীর বাসিন্দাদের। প্রশ্ন হচ্ছে এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী। জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়ালে তা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা ভেবে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। বর্তমানে জনসংখ্যা কোনোভাবেই আর বাড়তে দেওয়া চলে না। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের রিপোর্টের গবেষকরা বলছেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। এগুলোর মধ্যে আছে কম বয়সে বিয়ে, প্রজননক্ষম বিবাহিত নারীর উচ্চহার, মানুষের গড় আয়ু বাড়া, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বিফল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ অসচেতনতা ও অশিক্ষা। মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। আধুনিক সমাজে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। সামাজিক ট্যাবু ভেঙে বেরিয়ে আসতে সরকার ও নীতি-নির্ধারকদের দৃঢ়নিষ্ঠ কঠিন উদ্যোগ নিতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়াতে পাঠ্যপুস্তকে যৌনশিক্ষার মৌলিক বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইউরোপের দেশগুলোর জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে চিন্তিত। আর বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে তার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। আমরা অধিক জনসংখ্যা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি। ১৯৯৫ সালে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৫, সেখানে ২০০৫ সালে সেই হার হয়েছে ২.১। আর তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যদি এখনই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে তা অনুমিত হিসাবকে ছাড়িয়ে যেতে বাধ্য। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে প্রচার বাড়াতে হবে। একাধিক সন্তান গ্রহণের একটি বড় কারণ পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা। সমাজে কন্যাসন্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে এ অপসংস্কৃতি দূর করা অসম্ভব। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিকল্প নাই। চীনের এক সন্তান নীতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী উদাহরণ। আমরা এখনই এই নীতি গ্রহণ করতে না পারলেও দুই সন্তান নীতি বাধ্যতামূলক করার সময় চূড়ান্তভাবে উপস্থিত। ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুই সন্তানই যথেষ্ট’ শুধু এরকম প্রচারের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। এখনই আইন করে ঘোষণা করতে হবে ‘দুই সন্তানের বেশি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এখন দেশের চরম মহাসমস্যা হিসেবে ঘোষণার চূড়ান্ত সময় এসেছে। জনসংখ্যাকে দেশের একনম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। নারীর প্রজনন হার কমাতে পরিকল্পনা কর্মসূচি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অপরিণত বয়সে বিবাহের বিরুদ্ধে আইনকে আরও কঠোর করতে হবে। ঠিক কী কী কারণে এ কর্মসূচি পুরো মাত্রায় সফলতার মুখ দেখতে পারছে না—তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে কখনো জনসংখ্যা টাইমবোমার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া যাবে না। ঘড়ি টিক টিক করে বেজেই চলেছে, তাই এখনই সময় টাইম বোমাটিকে ডিফিউজ করতে হবে।

আমার নিবন্ধের প্রায় সমাপ্তিতে চলে এসেছি। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করে পাঠককে বিষয়টির ভয়াবহতার প্রচণ্ডতার ইঙ্গিত দিতে ২৪ জুন ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাংবাদিক মশিউল আলমের জন ঘনত্ব বিষয়ের ওপর লিখিত ‘আমরা মানুষ না ইঁদুর?’ নিবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করছি। মশিউল আলম মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের ‘মাউস প্যারাডাইস’ নামে দীর্ঘ গবেষণালব্ধ আবিষ্কারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কাহিনীটি এমন, ‘জন ক্যালহুন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইঁদুরদের নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণায় মেতে উঠেছেন। তার কৌতূহলের বিষয়টি ছিল স্বাভাবিক বসবাস ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় কোনো প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা যদি ক্রমে বাড়তে থাকে তাহলে কী ঘটতে পারে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি কয়েক জোড়া পূর্ণবয়স্ক মেয়ে ও পুরুষ ইঁদুর রেখে দিলেন। তাদের নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের ব্যবস্থা করলেন। বাসা বানাবার সরঞ্জামও রেখে দিলেন। তিনি নিশ্চিত করলেন বিড়াল বা অন্য কোনো ইঁদুরখেকো প্রাণী যেন ইঁদুরদের ওই ঘরে ঢুকতে না পারে। জন ক্যালহুন তাঁর ইঁদুরদের এই বাসস্থানের নাম দিলেন ‘মাউস প্যারাডাইস’ বা ইঁদুর স্বর্গ। সেই স্বর্গে ইঁদুরেরা পরমানন্দে ভোজন ও বংশবিস্তার করে চলল। একপর্যায়ে ক্যালহুন দেখেন, ইঁদুরেরা তাদের ঘরটির মাঝখানে রাখা খাবারের পাত্রগুলোর চারপাশে ভিড় করছে। চার প্রান্তে ও কোনায় খাবারের পাত্র আছে, সেগুলোতে পর্যাপ্ত খাবারও আছে, কিন্তু বেশির ভাগ ইঁদুর জড়ো হচ্ছে মাঝখানের খাবারের পাত্রগুলো ঘিরে। ভিড় দেখে ভিড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে অন্যরা। ফলে সেখানে ঠেলাঠেলি, মারামারি, কামড়াকামড়ি লেগে যাচ্ছে। ইঁদুর স্বর্গের সুখশান্তিময় পরিবেশ ক্রমেই অশান্ত, অস্থির হয়ে উঠছে।

এতেই শেষ নয়। ইঁদুরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ক্যালহুন দেখতে পেলেন ইঁদুরদের স্বর্গটি নরকে পরিণত হতে চলছে; দাপুটে পুরুষ ইঁদুরেরা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে; তারা দল বেঁধে ঘুড়ে বেড়ায়, একে মারে, ওকে কামড়ায়। তারা আক্রমণ চালায় বিশেষত মেয়ে ও বাচ্চা ইঁদুরের ওপর। তাদের যৌন আচরণে ভীষণ পরিবর্তন দেখা দেয়; কিছু ইঁদুর সম্পূর্ণভাবে সমকামী হয়ে ওঠে, আর একদল হয়ে ওঠে অতিকামী সর্বকামী (প্যানসেক্সুয়াল)। আর একদল হয় অতিকামী (হাইপারসেক্সুয়াল)। তাদের অত্যাচারে মেয়ে ইঁদুরেরা অতিষ্ঠ হয়ে ঘরসংসার ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়, বাসা বানাতে পারে না, বাচ্চাদের যত্ন নেয় না, কখনো কখনো এমনকি নিজের বাচ্চাদেরই কামড়ায়। ফলে বাচ্চারা মরতে থাকে, ইঁদুর রাজ্যের কোনো কোনো অংশে বাচ্চাদের মৃত্যুর হার এমনকি ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ওঠে। দাপুটে অত্যাচারী ইঁদুরদের উপদ্রবে নরম-সরম প্রকৃতির ইঁদুরেরা মানসিকভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, তারা ঘরটির প্রান্ত ও কোনাগুলোর দিকে সরে যায়। ক্যালহুন বলেন, এই ইঁদুরেরা শারীরিক অর্থে বেঁচে থাকে বটে, তবে তা বিরাট মনস্তাত্ত্বিক মাশুলের (ইমেন্স সাইকোলজিক্যাল কষ্ট) বিনিময়ে। যৌন আচরণ বদলে যাওয়া ও সহিংস নৈরাজ্যের ফলে একটা পর্যায়ে একদিকে ইঁদুরদের বংশবিস্তার কমে যায়, অন্যদিকে বাচ্চা ইঁদুরদের সিংহ ভাগই মারা যায়।

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।