সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা বা তাঁদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক সময় লাভবান হন। কিন্তু বাহ্যিকভাবে তা দেখা যায় না।
নিজের পদ বা ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যকে সুবিধা দেওয়া এবং নিজে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে তাঁরা যে দুর্নীতি করেন, সেটাকে আইনের আওতায় নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে নতুন আইন হচ্ছে।
‘স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইন’ শিরোনামে নতুন একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে আইন কমিশন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে এ আইনের খসড়া তৈরি করে সেটা আইন কমিশনের ওয়েবসাইটে মতামতের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দুদকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে আইনটি মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে সুশাসন জরুরি। কাজের স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এ আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’
দুদকের আইন শাখার মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নত কয়েকটি দেশে এ ধরনের আইন থাকলেও আমাদের দেশে এ আইনের ভাবনাটাই নতুন। দুদকই এর স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বার্থের সংঘাত সম্পর্কিত এ আইন হলে স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থসংক্রান্ত দুর্নীতির পথগুলো বন্ধ হবে।’
জানা গেছে, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের আগ্রহের কারণে এ আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাঁর আগ্রহের পেছনে ছিল প্রশাসনে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের সময় পাওয়া তথ্যও তাঁদের উৎসাহ জুগিয়েছে। দুদকের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বড় বড় প্রকল্পে ঠিকাদার বাছাই, নিয়োগ ও কার্যাদেশের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা অনেক সময় ব্যক্তিস্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নেন, যার কারণে প্রশাসনের সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জবাবদিহিও থাকে না।
আইনের খসড়া তৈরিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদকের অনুরোধে আমরা আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করে দুদকের কাছে দিয়েছি। আমাদের ওয়েবসাইটেও আছে। বিভিন্ন পক্ষের কাছে মতামতের জন্য দেওয়া হয়েছে।’
কী আছে আইনের খসড়ায়?
আইনের খসড়ায় ‘স্বার্থ সংঘাত’ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বা নিয়োজিত পরামর্শক বা উপদেষ্টারা তাঁদের সংশ্লিষ্ট কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনকালে কী কী পরিস্থিতির উদ্ভব হলে স্বার্থের সংঘাত ঘটবে, তা তুলে ধরা হয়। সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বা নিয়োজিত পরামর্শক বা উপদেষ্টাদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ তাঁদের দায়িত্ব পালনকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করলে স্বার্থর সংঘাত ঘটবে।
এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ বা পরোক্ষ লাভের সুযোগ তৈরি হলে অথবা স্বার্থের সংঘাতের কারণে কোনোরূপ অনৈতিক বা অন্যায় ফলাফল তৈরি হতে পারে।
সরকারের যেকোনো প্রকল্প ও ঠিকাদার বাছাই কমিটি মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়েই গঠিত হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে ওই সব কমিটিতে সরকারের বাইরে এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞকেও নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। আইনের খসড়ায় বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের কোনো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত কেউ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না।
আইনের খসড়ায় স্বার্থের সংঘাতবিষয়ক সম্ভাব্য পরিস্থিতির উদাহরণ তুলে ধরে আইনটির বিশ্লেষণ করা হয়।
খসড়ায় একটি উদাহরণে বলা হয়, ‘ক’ একটি প্রকল্পে দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর ছেলে ‘খ’ ওই প্রকল্পের একটি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। ‘খ’ ওই দরপত্র না পেলেও ‘ক’-এর বিরুদ্ধে এ আইনে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ আনা যাবে।
‘ক’ একটি সরকারি দপ্তর থেকে অবসর নেওয়ার ১২ মাস পর এমন একটি এনজিও প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন, যার সঙ্গে চাকরি থাকার সময় তার যোগাযোগ ছিল। এ ক্ষেত্রে ‘ক’-এর এ নিয়োগে স্বার্থের সংঘাত থাকবে।
‘ক’ এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকার সময় বিভিন্ন এনজিওকে কর অবকাশ দেওয়ার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেন। তিনি অবসর নেওয়ার ১৫ মাস পর একটি এনজিওতে যোগ দেন, যেটি তাঁর আগের কর্মকাণ্ডে কর রেয়াত পেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ‘ক’-এর নিয়োগে স্বার্থ সংঘাত থাকবে।
ওষুধ ক্রয় কমিটিতে নিয়োজিত ‘ক’-এর স্ত্রী ‘খ’-এর মালিকানাধীন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে ওই ক্রয় কমিটি ওষুধ কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। ‘ক’ ও ‘খ’-এর সম্পর্ক কমিটির অন্য সদস্যরা জেনেও ‘ক’-কে কমিটি থেকে অপসারণ করেনি অথবা চুক্তিটি বাতিল করেনি। এ অবস্থায় ‘ক’, ‘খ’ এবং ক্রয় কমিটির সদস্যরা এ আইনে অপরাধী হবেন।
‘ক’ একটি প্রকৌশল সংস্থায় একটি দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। ওই সংস্থার একটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কোম্পানির অন্যতম পরিচালক হলো ‘ক’-এর ছেলে ‘খ’। এ অবস্থায় ‘ক’ ও ‘খ’ এই আইনে অপরাধী হবেন।
‘ক’ সরকারি এক দপ্তরে দায়িত্ব পালনকালে সময়ে ওই দপ্তরের একটি দরপত্রসংক্রান্ত যাবতীয় গোপনীয় তথ্য একটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেন। ওই ফার্মটি যদিও দরপত্র পায়নি, তারপরও ‘ক’ এবং ফার্মটির সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা এ আইনে অপরাধী হবেন।
একটি সরকারি দপ্তরের কোনো কর্মকর্তা ওই দপ্তরের একটি প্রকল্প পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থার মালিকানাধীন এক অবকাশ যাপনকেন্দ্রে সপরিবারে বিনা খরচে অবকাশ যাপন করেন। এ ক্ষেত্রে ‘ক’ এবং ওই ফার্মের অংশীদাররা এই আইনের আওতায় অপরাধী হবেন।
‘ক’ একটি নিয়োগ কমিটিতে থাকাকালে তাঁর ছেলে ‘খ’ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নেয়। ‘ক’ ওই তথ্য গোপন রাখেন। ‘ক’ এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবেন।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ‘ক’-এর স্ত্রী ‘খ’ একটা তেল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার। ওই তেল কোম্পানির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে ‘ক’ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সব সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে চুক্তি সম্পাদন করেন। ‘ক’ এ কথা কখনো উল্লেখ করেননি এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এ সম্পর্কের কথা জেনেও চুক্তি বাতিল করেনি। এ অবস্থায় ‘ক’ এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবেন।
একটি স্বত্ব ঘোষণার মামলায় ‘ক’ ও ‘খ’ দুই পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। ওই মামলার আইনজীবী ‘ক’-এর জুনিয়র ‘গ’ ওই মামলার বিচারক ‘ঘ’-এর পুত্র। ‘ঘ’ এ ঘটনা জানা সত্ত্বেও মামলাটির শুনানি করেন। ‘ক’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবেন।
সরকারি যেকোনো উন্নয়নকাজে ‘এ’ ক্যাটাগরির সিমেন্টের ব্যবহার বাধ্যতামূলক জেনেও ‘ক’ তাঁর সরকারি দপ্তরের যাবতীয় উন্নয়নকাজে তাঁর ভাই ‘খ’-এর মালিকানাধীন সিমেন্ট কারখানার ‘বি’ ক্যাটাগরির সিমেন্ট ব্যবহার করে। এ ছাড়া ‘ক’ অন্যান্য দপ্তরকেও ‘বি’ ক্যাটাগরির সিমেন্ট ব্যবহার করতে প্রভাবিত করেন। ‘ক’ এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবেন।
‘ক’ একটি হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ‘ক’-কে একটি ফ্ল্যাট উপহার দেয়। বিনিময়ে ‘ক’ তাঁর কর্মক্ষেত্রে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহ করা ‘টেস্ট ক্যাটালগ’ বইতে টিক দিয়ে রোগীদের ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য পাঠান বলে প্রমাণিত হয়। ‘ক’ এবং ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবে।
‘ক’ একটি হাসপাতালের ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালীন একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ‘ক’-কে বিদেশে একটি সেমিনারে যাওয়ার জন্য যাবতীয় ব্যয় বহন করে। সরেজমিনে ‘ক’ তাহার কর্মক্ষেত্রে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত ‘টেস্ট ক্যাটালগে’ টিক দিয়া রোগীদের সেখানে পরীক্ষার জন্য পাঠান বলে প্রমাণিত হয়। ‘ক’ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবে।
চিকিৎসক ‘ক’-কে তাঁর কর্মক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সব রোগীকে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে দেখা যায়। প্রমাণিত হয় যে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ‘ক’-কে কমিশন বাবদ প্রতিটি রোগীর পরীক্ষার ফির ৪০ শতাংশ দেয়। ‘ক’ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবে।
ডাক্তার ‘ক’ তার রোগীদের একটি বিশেষ পরীক্ষার জন্য একজন বিশেষ বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক বা বিশেষ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। ওই পরীক্ষা বিষয়ে তাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ‘ক’ এবং ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবে না।
একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একটি কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ দেয়। ওই কোম্পানি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের পারিবারিক মালিকানাধীন, যেটা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য জানতেন। ওই পর্ষদের দুজন সদস্য ঋণ দিতে বিরোধিতা করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে ঋণটি মঞ্জুর হয়। পরিচালনা পর্ষদের বিরোধিতাকারী ওই দুজন ছাড়া অন্য সদস্যরা এ আইনে অভিযুক্ত হবেন।
দুদকের চাওয়া পূরণ হবে?
সরকারি কাজে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করার ভাবনা থেকে দুদক আইনটি তৈরির জন্য আইন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছিল। আইনের খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে দুদক চেয়ারম্যান ও দুদকের আইন শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। দুদক চেয়েছে, আইনটি প্রণয়ন করে দুদকের তফসিলভুক্ত হোক।
কিন্তু আইনের খসড়ায় আইন কমিশন এ আইনের জন্য আলাদা কমিশনের সুপারিশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আইন কমিশন সূত্র জানায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করে তাঁদের কাছে মনে হয়েছে এ জন্য আলাদা কমিশন দরকার। তবে দুদকের আইন শাখার মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের প্রেক্ষাপট থেকে দুদকই এ আইনের প্রস্তাব করেছে। তাই এ আইন দুদকের তফসিলভুক্ত থাকা উচিত।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘প্রথমে আইনটি হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। তারপর এটা নির্ধারণ করা যেতে পারে, কার এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধ কাজ করে। তবে আমি মনে করি, এত কমিশনের দরকার নেই।’