আসিফ কেন কারাগারে

শফিক তুহিনের করা মামলায় জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের একটি টিম গ্রেফতার করে। এরপর গতকাল তাকে আদালতে হাজির করলে বিচারক জামিন ও রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ।

গত সোমবার সন্ধ্যায় আসিফ আকবরের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন শফিক তুহিন। মামলার এজাহারে শফিক তুহিন অভিযোগ করেন, গত ১ জুন আনুমানিক রাত ৯টার দিকে চ্যানেল ২৪-এর সার্চলাইট নামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন আসিফ আকবর অনুমতি ছাড়াই তার সংগীতকর্মসহ অন্যান্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের ৬১৭টি গান সবার অজান্তে বিক্রি করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পারেন, আসিফ আকবর আর্ব এন্টারটেইনমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে গানগুলো ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে ট্রু-টিউন, ওয়াপ-২, রিংটোন, পিআরবিটি, ফুলট্রেক, ওয়াল পেপার, অ্যানিমেশন, থ্রি-জি কনটেন্ট ইত্যাদি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যবহার করে অসাধুভাবে ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। পরে ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত ২ জুন রাত ২টা ২২ মিনিটে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে অনুমোদন ছাড়া গান বিক্রির এই ঘটনা উল্লেখ করে একটি পোস্ট দেন। তার ওই পোস্টের নিচে আসিফ আকবর নিজের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে অশালীন মন্তব্য ও হুমকি দেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, পরের দিন রাত ৯টা ৫৯ মিনিটে আসিফ আকবর তার প্রায় ৩২ লাখ লাইকার সমৃদ্ধ ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাইভে আসেন। ৫৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড লাইভ ভিডিওর ২২ মিনিট থেকে তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর, অশালীন ও মিথ্যা-বানোয়াট বক্তব্য দেন।

ভিডিওতে আসিফ আকবর তাকে (শফিক তুহিন) শায়েস্তা করবেন এ কথা বলার পাশাপাশি ভক্তদের উদ্দেশে বলেন, তাকে যেখানেই পাবেন সেখানেই প্রতিহত করবেন। এই নির্দেশনা পেয়ে আসিফ আকবরের ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে হত্যার হুমকি দেন। আসিফ আকবরের এই বক্তব্য লাখ লাখ মানুষ দেখেছে। তিনি উসকানি দিয়েছেন। এতে তার (শফিক তুহিন) মানহানি হয়েছে। বিষয়টি সংগীতাঙ্গনের সুপরিচিত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার প্রীতম আহমেদসহ অনেকেই জানেন বলেও উল্লেখ করেছেন শফিক তুহিন।

 

আসিফের যত কথা

গতকাল আদালতে আসিফ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওই আগে বলেছে। মামলাতো আমারই আগে করা উচিৎ ছিল।’

ঘটনার সুত্রপাত গত ২ জুন রাতে। সেদিন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসেন আসিফ। সেখানে শফিক তুহিনের স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। আসিফ বলেন, ‘শফিক তুহিন তার স্ট্যাটাসে স্বাক্ষর জালিয়াতির কথা বলেছেন। কিন্তু এখানে স্বাক্ষর জালিয়াতির কিছু নেই। প্রকৃত বিষয়টি হচ্ছে উল্লিখিত কাগজে আসিফ আকবর শফিক তুহিনসহ অন্যদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন। ফলে এখানে জালিয়াতির কিছু নেই।’ এ ছাড়া আসিফ আকবর বলেন, ‘তখন শফিক তুহিন, প্রীতম আহমেদসহ অন্য সবার মৌখিক অনুমতিক্রমেই সবার পক্ষে তিনি স্বাক্ষর করেছেন।’ আসিফ আকবর পুরনো দিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এই কপিরাইট নিয়ে আমিই সবার আগে মুখ খুলেছি। গানের অধিকার আদায় করতে গিয়ে আট বছর গান থেকে দূরে থেকেছি। সেই আমি যখন আট বছর পর ফিরে এসে চুটিয়ে কাজ করছি, তখন এটাই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ আসিফ তার লাইভ ভিডিওতে প্রীতম ও শফিক তুহিনদের সমালোচনা করে বলেন, ‘গানের আঙিনা সুন্দর মানুষদের জন্য। এখানে কোনো নর্দমার কীট রাখা যাবে না। শফিক তুহিন কৌশলী। আমার হাত দিয়ে তার উত্থান। আমার সঙ্গেই বেইমানি করে বেড়াচ্ছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই আমাকে অভিযুক্ত করছে। এ ধরনের ক্ষতিকরদের থেকে সবার সাবধান থাকা উচিত।’ তিনি প্রীতম আহমেদ ও শফিক তুহিনের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে এর পক্ষে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে এ দুজনকে অকৃতজ্ঞ বলেই তুলে ধরেন। শুধু তাদেরই নয়,  শফিক তুহিন, প্রীতমসহ আরও একাধিকজনকে বয়কটের আহ্বান জানান আসিফ।’

 

রিমান্ড ও জামিন আবেদন নামঞ্জুর, কারাগারে

সিআইডির উপ-পরিদর্শক প্রলয় রায় আদালতে রিমান্ড আবেদন করেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মামলার আসামি আসিফকে জামিন দিলে পলাতক হতে পারেন। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন এবং মূল হোতাকে খুঁজে বের করার জন্য আসামি আসিফকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আসিফের সহযোগীদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আর এই কাজে ব্যবহার করা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের পরিচিতি এবং আসিফের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানার জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন।’ আসিফকে হাজতখানা থেকে আদালতে তোলা হয় বুধবার দুুপুরের দিকে। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে আদালত। সেই সঙ্গে তার জামিন আবেদনও নামঞ্জুর করেছে আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম উভয় পক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। সেই সঙ্গে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আসিফের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, শিগগিরই আবার জামিনের জন্য আবেদন করা হবে।

 

সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে

মঙ্গলবার মধ্যরাতে আটকের ঘটনা নিয়ে বুধবার সারা দিন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল আসিফের দখলে। আসিফ ভক্তদের মধ্যে তাকে মুক্তি দেওয়ার পোস্টে ছেয়ে গিয়েছিল ফেসবুক। এদিকে যেহেতু আসিফ ও শফিক তুহিন দুজনে একই অঙ্গনের মানুষ, তাই মিডিয়ার অনেকেই বিষয়টির দ্রুত সমাধান আশা করেছেন। একাধিক শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করার পর তারা দাবি করেছেন, এখানে সিনিয়রদের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। শিল্পী-শিল্পী কিংবা শিল্পী-গীতিকার একটা পরিবারের মতো। সেই পরিবারে ঝামেলা হতেই পারে। সেক্ষেত্রে ফেসবুক লাইভে এসে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা যেমন সমীচীন নয়, ঠিক তেমনি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর আগেই এটির সমাধান সম্ভব ছিল। তবে সিনিয়রদের মীমাংসার উদ্যোগের সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি বলেই মানছেন অনেকে। তাদের দাবি, শেষ পর্যন্ত এ ধরনের ইস্যুতে মূল ক্ষতিটা ইন্ডাস্ট্রিরই।