তেইশেও বিপর্যস্ত ডেঙ্গুতে, হুঁশ ফিরবে কি চব্বিশে?

করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ে খুবই আলোচিত ছিল ২০২২ সাল। সে বছর টিকার সাফল্যে করোনা থেকে স্বস্তি ফিরলেও ডেঙ্গুতে অনেকটা নাজেহাল ছিল স্বাস্থ্য খাত। ২০২৩ সালে করোনামুক্ত নতুন বিশ্বে এসে ডেঙ্গু মোকাবিলা করাই ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের অন্যতম লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এবারও ডেঙ্গুতে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে মানুষকে।

বিদায়ী বছরে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে ডেঙ্গুতে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ডাব-স্যালাইনের সিন্ডিকেট, রোগীদের ‘জিম্মি’ করে ওষুধপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর– এক বছরে স্বাস্থ্য খাতে আলোচিত-সমালোচিত কিছু ঘটনা ফিরে দেখার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট।

বিদায়ী বছরে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে ডেঙ্গুতে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ডাব-স্যালাইনের সিন্ডিকেট, রোগীদের ‘জিম্মি’ করে ওষুধপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত এক বছরে ডেঙ্গুতে যে পরিমাণ আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, আগের কোনো বছরে এমনটা ঘটেনি। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে না লাগানো, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা না থাকায় বর্তমান পরিণতি অবধারিত ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন (২২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার ১৫৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালে দেশে সর্বমোট ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ৬১ হাজার ৭৬৩ জনের। ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের।

দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে, প্রথমবারের মতো এর ব্যাপকতা দেখা দেয় ২০১৯ সালে। শনাক্ত হয় সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী। ওই বছর রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২১ সালে রোগী ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১০৫ জনের।

একটা সময় ডেঙ্গুর সংক্রমণকে শহরের রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন সেটি ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। রাজধানীর চেয়ে তিনগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার ১৫৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ নয় হাজার ৭৪৩ জন। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১০ হাজার ৪১৫ জন।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১৯৩ জন। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৬৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৮২৬ জন। চলতি বছরের এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিন লাখ ১৭ হাজার ২৭৩ জন।

এ বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গু ইতোমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। একটা সময় ছিল ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যেত। এখন প্রায় সমান হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের আউটব্রেকে আমরা দেখছি, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতে ডেঙ্গু রোগী। মোট রোগীর ৩৫ শতাংশ ঢাকা এবং ৪৪ শতাংশ ঢাকার বাইরের। এমনকি ৮৬ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে হাসপাতালের চারপাশের দুই কিলোমিটারের মধ্যে।

একসময় বর্ষার সিজন এলেই দেশে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া যেত। তবে, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া, বৃষ্টির বাইরে বছরব্যাপী চলা নানা উন্নয়নমূলক কাজসহ বিভিন্ন কারণে জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। এ কারণে বিপদ এড়াতে দেশজুড়ে সারা বছর মশক নিধন কার্যক্রম চালানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন, মারা গেছেন ছয়জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৬ জন, মারা গেছেন তিনজন। মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন। এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন, মারা গেছেন দুজন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৩৬ জন, মারা গেছেন দুজন। জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন, মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইয়ে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন শনাক্ত, প্রাণহানি ৩৪২ জনের। সেপ্টেম্বরে শনাক্ত রোগী ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন, মারা গেছেন ৩৯৬ জন। অক্টোবরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬৭ হাজার ৭৬৯ জন, মারা যান ৩৫৯ জন। নভেম্বরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪০ হাজার ৭১৬ জন, মারা গেছেন ২৭৪ জন। ডিসেম্বরের ২২ দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ২৬৭ জন, মারা গেছেন ৭০ জন।

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি মনে করি, ডেঙ্গু এখন সারা বছরই চলবে। সারা বছর চলা মানে প্রতিদিন পাঁচ/সাতজন করে মারা যাবে। ফলে বছর শেষে ডেঙ্গুতে বহু মানুষের মৃত্যু হবে। বর্তমানে দেশের আবহাওয়ার যে অবস্থা, ভালো করে শীতও নেই, আবার গরমও নেই। অল্প একটু ঠান্ডা লাগে সকালে আর শেষ রাতে। আবহাওয়ার এমন আচরণের মধ্যে মশার প্রজনন কিন্তু ঠিকই চলতে থাকবে।’

এ বিষয়ে ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর কোনো টাইম ফ্রেমে নেই। এ বছরের পুরোটা সময় আমরা ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখেছি। হয়তো এখন থেকে এভাবে চলবে। তবে, এ বছরের মে, জুন, জুলাই– এ তিন মাসে এডিসের প্রজনন হার অনেকটা বেশি ছিল। এ সময়ে বৃষ্টিও বেশি হয়। কাজেই আমরা যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে এ সময়ের আগেই মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটা করতে হবে।’

দেশের ইতিহাসে রেকর্ড ডেঙ্গু সংক্রমণের বছরে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে রোগীদের। হাসপাতালগুলোতে নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে। এদিকে, রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধতা থাকায় চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের।

বছরব্যাপী ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় রোগীদের জন্য ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। রাজধানীর যেকোনো এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীরা ছুটে আসেন মুগদা হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য মতে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৪৬৯ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে আট হাজার ৯৪৩ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে আট হাজার ৮৮৪ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আট হাজার ৬০১ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সাত হাজার ৭৫৯ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চার হাজার ৩৫৬ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

এ ছাড়া, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। সেখানে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫৪৯ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে দুই হাজার ১৮৩ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল এক হাজার ৯৭৫ জন, আজগর আলী হাসপাতালে এক হাজার ৮৫৮ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে এক হাজার ৬৬২ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

২০২৩ সালের জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি থাকায় সে সময় রোগীদের রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে যায়। দিনদিন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রাজধানীর ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে রক্ত ও প্লাটিলেটের জন্য জমতে থাকে ভিড়। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় এসব প্রতিষ্ঠানকে।

রক্তে প্লাটিলেট ৪০-৫০ হাজারের মধ্যে এলেই রোগীর স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যায়। যদিও বাস্তবতা হলো, প্লাটিলেট যদি ২০ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে নেমে আসে— এমন অবস্থায়ও রোগীর প্লাটিলেট নাও লাগতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে এসেছেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেটের ভূমিকা প্রধান নয়। এ নিয়ে অযথা ভয়ে থাকে মানুষ। ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত না হয়ে অন্য কিছু লক্ষণের দিকে নজর রাখতে বলেছেন তারা।

বিশিষ্ট ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, আমরা বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে প্লাটিলেটের চাহিদাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। কিন্তু যখন দেখছি যে, সংকটময় পরিস্থিতিতেও এর অপব্যবহার হচ্ছে, সেটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। সে সময়টায় প্লাটিলেটের ডোনার সহজলভ্য ছিল না। আমরা ডোনারের তীব্র সংকট দেখেছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ঠিক মতো ডোনার পাচ্ছিলাম না। সেই পরিস্থিতিতেও প্লাটিলেটের অযাচিত ব্যবহার হয়েছে।

‘প্লাটিলেট পাঁচ হাজার কাউন্টেও অনেকে ভালো থাকেন। দেখা যায়, তার কোনো ধরনের লক্ষণ নেই, কোনো প্রকার রক্তক্ষরণ নেই। প্লাটিলেটের সঙ্গে কিন্তু রক্তক্ষরণের সম্পর্ক নেই। তার মানে হলো, প্লাটিলেট পাঁচ হাজার কাউন্টেও যেমন রোগীকে খারাপ বলা যায় না, আবার এক লাখ থাকলেও ভালো বলা যায় না। অর্থাৎ কারও ক্ষেত্রে এক লাখেও রক্তক্ষরণ হতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে পাঁচ হাজারেও রক্তক্ষরণ হয় না।’

বছরের শেষের দিকে ডেঙ্গু বেড়ে গেলে দেশে স্যালাইন নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বাজারে স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়। ফলে নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি হয়। এতে বিপাকে পড়েন দরিদ্র রোগী ও তাদের স্বজনরা। ওই সময় সরেজমিনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল-সংলগ্ন একাধিক ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ফার্মেসিতে স্যালাইনের সংকট। কিছু ফার্মেসিতে পাওয়া গেলেও ৯০ টাকার স্যালাইন তখন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নিশাত মেডিসিনের এক বিক্রয়কর্মী তখন বলেছিলেন, আমরা তো স্যালাইন পাচ্ছি না। কোম্পানিগুলোকে বারবার চাহিদা দিয়েও পাচ্ছি না। অনেক সময় এক কার্টন অর্ডার দিলে ১০ পিস দিয়ে যায়। রোগীরা এলে তাদের চাহিদা মতো দিতে পারছি না। কেউ কেউ এ সুযোগে দাম বাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে।

এদিকে, স্যালাইন সংকটের কথা স্বীকার করলেও যেন অনেকটাই অসহায় ছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তাদের ভাষ্য মতে, কোনো লিডিং ফার্মাসিউটিক্যালস স্যালাইন বা কোনো ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করেনি। কারণ, এটা তাদের বাজারে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা। চাহিদা বাড়ার কারণে প্রতিদিন ওরিয়ন ৩০ হাজার লিটার, অপসোনিন ২৭ হাজার লিটার, বেক্সিমকো ও পপুলার তাদের স্বাভাবিক উৎপাদন চালু রেখেছে। এমনকি শুক্রবার বন্ধের দিনেও তারা স্যালাইন উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে।

বিক্রেতাদের ওপর দায় চাপিয়ে ওই সময় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল আলম সাংবাদিকদের জানান, যখন চাহিদা বেশি থাকে, তখন কোম্পানির পক্ষ থেকে সাপ্লাই বন্ধ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সংকট বিক্রেতারা তৈরি করেন। ওষুধ মজুত রেখে তারা কৃত্রিম সংকট দেখান, যেটার প্রমাণ আমরা অনেকবার অভিযানে গিয়ে পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, এভাবে সংকট দেখানোর পেছনে একটা দুষ্টু চক্র কাজ করছে। এরা একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। ডেটা থেকেই বোঝা যায়, কোনো সংকট নেই।

ডাব, মাল্টার দাম বাড়িয়ে ডেঙ্গু রোগীদের ‘জিম্মি’

ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতালগুলো যখন কানায় কানায় পূর্ণ, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে ডাব, মাল্টার দাম বাড়িয়ে ডেঙ্গু রোগীদের ‘জিম্মি’ করার নানা খবর। সরেজমিনে তখন দেখা যায়, ডেঙ্গুর সুযোগে হাসপাতালের গেট ও আশপাশের ফুটপাতে মানুষের পকেট কাটছেন ডাবসহ বিভিন্ন ফল বিক্রেতারা। তারা দ্বিগুণেরও বেশি দাম নিচ্ছেন। সবমিলিয়ে গরীব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীরা খুবই অসহায় বোধ করেছেন।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ পুঁজি করে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় সক্রিয় হয়ে ওঠে ডাব সিন্ডিকেট। বিশেষ করে হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে সিন্ডিকেটটি। শুধু ডাব নয়, প্রতিটি ফলের দামেই যেন আগুন লেগেছিল তখন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-সংলগ্ন ফুটপাতে গিয়ে তখন দেখা যায়, সেখানে চড়া দামে বিক্রি হয় ডাব, কমলা, আপেল ও মাল্টাসহ নানা ফল। প্রতিটি ডাবের দাম রাখা হয় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যে ডাব ৮০ থেকে ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি হাসপাতাল গেটে বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ২০০ টাকায়। আপেল বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়, যা সাধারণত বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। মাল্টা বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়, যা সাধারণত বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়।

এবারও ডেঙ্গুতে নাকাল স্বাস্থ্য খাত : কী হবে নতুন বছরে

ডেঙ্গু সংক্রমণে কেমন ছিল ২০২৩ সাল, ডেঙ্গুতে বিপর্যয়ের কারণ এবং ২০২৪ সালে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হবে— এসব বিষয়ে একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। এ বিষয়ে ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘করোনার রেশ না কাটতেই আমাদের ডেঙ্গু মোকাবিলায় পর্যুদস্ত হতে হয়েছে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময় আমাদের ডেঙ্গু নিয়ে কেটেছে। ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যের অন্য দিকগুলোতে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের যতটা অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা আমরা করতে পারিনি।’

ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা কতটা সফল হয়েছি– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা সফল হয়েছি, এটা আমি বলতে চাই না। আমার মতে, ডেঙ্গু সংক্রমণ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। এর কারণ হলো, আমরা সময় মতো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারিনি।’

বিপর্যয়ের কারণ প্রসঙ্গে ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কোনো কাজ করতে পারলাম না। এমনকি সমন্বিতভাবে কাজের কোনো চেষ্টাও করলাম না। আমরা দেখলাম না দুই মন্ত্রণালয় আর সিটি কর্পোরেশনকে যৌথ কোনো মিটিং করতে। অন্তত দুই মন্ত্রণালয়ের সচিবদের উচিত ছিল একসঙ্গে বসা এবং পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা সেটিও দেখলাম না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।’

নতুন বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি কেমন হবে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছর যেমনটা হয়েছে, নতুন বছরেও তেমনটা হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যক্রম এভাবে চলতে থাকা মানে আমরা আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি না। সমন্বিতভাবে কাজ না করলে ডেঙ্গু যে সারা বছর চলতেই থাকবে, বিশ্ববাসীর জন্য তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশ।’

আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখন আমাদের সর্বোচ্চ লেভেল থেকে হস্তক্ষেপ দরকার। এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলেই কাজ হবে। সবকিছু যেন হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক। প্রধানমন্ত্রী যদি বলতেন, এটা খুবই জরুরি, তোমরা সবাই কাজ করো, তাহলে সব মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে উঠে-পড়ে লাগত। সামনে নির্বাচন, যে কারণে প্রধানমন্ত্রীও এদিকে নজর দিতে পারছেন না। ডেঙ্গুর মৌসুম পার হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

ব্যক্তি সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিকল্প নেই : অধ্যাপক নাজমুল

দেশে চলমান ডেঙ্গু সংক্রমণ ও নতুন বছরে করণীয় প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একসময় ডেঙ্গু শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়।

‘২০২৩ সাল যেমনই হোক, নতুন বছরে আমরা কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করব, সেটাই বড় ভাবনা। আমরা বিষয়টা নিয়ে কাজ করছি। তবে, আমরা যত কিছুই করি না কেন ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিকল্প নেই।’