মাঝেমধ্যেই আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ লাফায়। অর্থাৎ ত্বকের নিচে নির্দিষ্ট স্থানে অনবরত কাঁপুনি সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ সময়ই দুই-একবার এমনটা হয়ে থেমে যায়। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই যদি দেহের নির্দিষ্ট অংশের মাংস লাফায় তবে সতর্ক হওয়া জরুরি।
বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোম: শরীরের মাংস লাফানো এক ধরনের স্নায়ুভিত্তিক শারীরিক সমস্যা। অন্যভাবে বলা যায় বড় ধরনের শারীরিক সমস্যার ইঙ্গিত। ইংরেজিতে এই সমস্যাকে বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোম (Benign Fasciculation Syndrome) বা বিএফএস বলা হয়। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যখন কোনো ধরনের শারীরিক জটিলতা ছাড়াই শরীরের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা বারবার কাঁপতে থাকে বা লাফাতে থাকে।
বিএফএস সাধারণত কোনো ব্যথা সৃষ্টি করে না। এটি কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে ঘণ্টাখানেক স্থায়ী হতে পারে। বিরক্তি সৃষ্টি করলেও সাধারণত এই কাঁপুনি কোনো শারীরিক ক্ষতি করে না।
শরীরের মাংস লাফানোর সমস্যা কাদের হয়? যেকোনো বয়সী ব্যক্তির এই সমস্যা হতে পারে। তবে বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের এমনটা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অন্যদিকে যারা বিরতি ছাড়াই দীর্ঘদিন শারীরিক পরিশ্রম করেন তাদেরও এমনটা হয়ে থাকে। ৭০% সুস্থ মানুষ জীবনদশায় কোনো না কোনো সময় বিএফএস অনুভব করেন।
বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোমের লক্ষণ: বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোমের মূল লক্ষণ মাংসপেশী লাফানো। পেশী শিথিল বা বিশ্রামে থাকা অবস্থায় এই অনুভূতি বোঝা যায়। এটি কয়েক মাস এমনকি বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে।
দেহের কোন অংশের মাংস লাফায় বেশি? এই সমস্যাটি শরীরের যে কোনো অংশেই দেখা দিতে পারে। তবে যেসব জায়গায় বেশি হয়ে থাকে সেগুলো হলে- পায়ের মাংসপেশী (হাঁটুর পেছনের অংশ বা কাফ মাসল), উরু, চোখের পাতা, নাক, হাতের বাহু, হাত
কিছু ক্ষেত্রে রোগী মাংসপেশিতে কাঁপুনির পাশাপাশি টানও অনুভব করেন। যাকে ক্র্যাম্প ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোম (সিএফএস) বলে।
শরীরের মাংস লাফায় কেন? পেশী নিয়ন্ত্রণ করে এমন একটি একক পেরিফেরাল নার্ভ যখন অত্যধিক সক্রিয় হয়ে যায় তখন মাংসপেশী লাফাতে শুরু করে। এর ফলে অনৈচ্ছিক পেশী আন্দোলন শুরু হয়।
গবেষকরা বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোমের সঠিক কারণ এখনও খুঁজে পাননি। তবে মাংস লাফানোর সঙ্গে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জড়িত সেগুলো হলো- মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব, ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল গ্রহণ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা, স্থূলতা, কঠোর ব্যায়াম, ট্রমা, সাম্প্রতিক ভাইরাল সংক্রমণ, হাইপারথাইরয়েডিজম ইত্যাদি
চিকিৎসা কী? দীর্ঘদিন শরীরের মাংস লাফালে একজন নিউরোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসক প্রাথমিক উপসর্গের ওপর নির্ভর করে নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা, ইলেক্ট্রোমিয়োগ্রাম (ইজিএম), রক্ত পরীক্ষা, থাইরয়েড পরীক্ষা, মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ম্যাজিং পরীক্ষা করতে দিতে পারেন।
রোগের অবস্থান ও পরিস্থিতি অনুযায়ী পরামর্শ বা ওষুধ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ন্যাফটিড্রফারিল (একটি ওষুধ যা রক্তনালীগুলিকে শিথিল করে), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (যেমন- ডিল্টিয়াজেম) খেতে দিতে পারেন।
শরীরের মাংস লাফালে কী করবেন? হঠাৎ শরীরের কোনো স্থানের মাংসপেশি লাফালে একটি চেয়ারে বা মেঝেতে বসে পা দুটোকে সামনে সোজা করে দিন। এরপর পায়ের পাতা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে নিজের দিকে টানুন। এভাবে কিছুক্ষণ থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। তবে কেবল এই টোটকা কাজে লাগালে হবে না। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পরিমিত ঘুম ও বিশ্রাম জরুরি।
মনোযোগ দিতে হবে খাদ্যতালিকায়ও। শাকসবজি, ফল, ডিম, দুধ, মাংস ও খেজুর খান পর্যাপ্ত পরিমাণে। ক্যাফেইন অর্থাৎ চা-কফি কিংবা অ্যালকোহলের নেশা থাকলে তা বাদ দিন। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেটিও ছাড়তে হবে।
বেশি করে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবার খান। প্রচুর পানি পান করুন। সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। প্রাণীজ প্রোটিন, ভিটামিন ডি, আয়রন আর খনিজ জাতীয় খাবার খান।
সাধারণভাবে দেহের মাংস লাফানোকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। কারণ একটু পরেই এটি ঠিক হয়ে যায়। তবে বারবার যদি এরকম হয় তাহলে অবশ্যই স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে ওষুধ সেবন করতে হবে।
সমস্যার সমাধান না হলে ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্নও হওয়া লাগতে পারে। কারণ মাংস লাফানো মস্তিষ্কের জটিলতা, এপিলেপসি কিংবা প্যারালাইসিসের লক্ষণ হতে পারে। অনেকক্ষেত্রে শরীরের যে অংশে মাংস বেশি লাফায় সেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ জটিলতাও থাকতে পারে। তাই সাধারণ হলেও এই ব্যাপারটিতে অবহেলা করা চলবে না।
তথ্যসূত্র: বেনাইন ফ্যাসিকুলেশন সিন্ড্রোম ডট অর্গ, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ডট অর্গ, হেলথলাইন ডট কম