সেঁজুতি (ছদ্মনাম)। বয়স ৩৬। বাড়ি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে টিকটক করতে গিয়ে ফেসবুকে পরিচয় হয় ওমান প্রবাসী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক হয় তাদের। কিন্তু রফিকুল যে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভনই দেখিয়েছেন, তা বুঝতে পারেননি তিনি। এরই একপর্যায়ে গত বছর ২ ফেব্রুয়ারি সেঁজুতি ঢাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে একাই চলে যান ওমানে রফিকুলের কাছে। প্রেমের টানে নিজে ওমানে গেলেও কাজের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পতিতালয়ে ঠাঁই হওয়া অর্ধশতাধিক নারীর দেখা পান সেঁজুতি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গেছেন ৭০ হাজারের বেশি নারী। আর ওমানে বিভিন্ন কাজের জন্য নারী গেছেন প্রায় ১০ হাজার।
সেঁজুতির ভাষ্যমতে, ২ ফেব্রুয়ারি সকালে ওমানে পৌঁছালে বিমানবন্দরে রফিকুল তাকে রিসিভ করেন। এরপর তার পাসপোর্ট, ভিসা কপি, বিএমইটি কার্ড নিয়ে নেন। বিমানবন্দর থেকে আলখুর নামে একটি স্থানের বাসায় তাকে নিয়ে যান রফিকুল। সেখানে তাকে ধ’র্ষণ করেন তিনি। ধ’র্ষণে বাধা দিলে তাকে বিয়ে করবেন বলে প্রলোভন দেখান। ওই দিন থেকে ওই বাসাতেই আটকে রাখা হয় তাকে। সেখানে বিয়ের আশ্বাসে প্রতিনিয়ত চলে ধ’র্ষণ। তবে ওমানে পরিচিত কেউ না থাকায় এবং বাসার বাইরে যেতে না পারায় প্রতিবাদ করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না ওই নারী। প্রায় তিন মাস ওই বাসায় সেঁজুতি দিনের পর দিন ধ’র্ষণের শিকার হয়েছেন। এরপর বিয়ে না করায় এবং কোথাও কোনো কাজ না দেওয়ায় রফিকুলকে চাপ দেন তিনি।
রফিকুল তার বাসায় কালাম, কাজী ও জিলানী নামে তিনজনকে ডেকে আনেন। তাদের সঙ্গে সেঁজুতিকে যেতে বলেন এবং জানান, তারা তাকে হাসপাতালে কাজ দেবেন। সেঁজুতি কাজের জন্য তাদের সঙ্গে গেলে তারা তাকে ওমানের ছিববাজার নামে একটি স্থানের একটি ঘরে নিয়ে রাখেন। সেখানে নেওয়ার পর তারা তাকে কাজ না দিয়ে প্রতিদিন তার ঘরে বিভিন্ন লোক ঢুকিয়ে দেন। ওইসব লোক ঘরে ঢুকে তাকে ধ’র্ষণ করেন। এসব কাজে বাধা দিলে কালাম, কাজী ও জিলানী তাকে বলেন, রফিকুলের কাছ থেকে তারা তাকে এসব কাজের জন্যই কিনে এনেছেন। সেঁজুতি বলেন, ‘এভাবে প্রতিদিন আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চলতে থাকে। আমি কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। রফিক আমার মোবাইল ফোন রেখে দিয়েছিল।
প্রায় ২০ দিন পর রফিক আমার সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কেন আমাকে কাজ না দিয়ে এখানে পাঠাল। তখন সে আমাকে মারধর করে। আর বলে, এই কাজই করতে হবে। প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন লোক আমাকে ধ’র্ষণ করত। এভাবে প্রায় আট মাস আমাকে ধ’র্ষণ করা হয়েছে।’ তবে সেঁজুতির মতো এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে ২০১৯ সালেই দেশে ফিরে আসেন আরও দুই নারী। তারা অভিযোগ করেন, তাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজের কথা বলে ওমানে নেওয়া হলেও কাজ করতে হতো বিভিন্ন বাসায়। বাসায় কাজ করতে না পারলে বা যৌনকাজে রাজি না হলে অফিসে এনে লাইন করে দাঁড় করানো হতো। তারপর মালিকরা গরুকে যেভাবে পছন্দ করেন অনেকটা সেই রকম পদ্ধতিতে পছন্দ করতেন। এভাবে হাতবদল হতে হয় একাধিকবার।
দিনের পর দিন ধ’র্ষণের শিকার হতে থাকা সেঁজুতি একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লে নাজিম নামে এক ব্যক্তি তাকে দূতাবাসে নিয়ে আউটপাস সংগ্রহ করে দেয়। গত বছর ২৮ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে আসার পর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন সেঁজুতি। তিনি বলেন, ‘ফিরে আসার পর রফিককে ফোন করি। কেন আমার সঙ্গে এ অন্যায় করা হলো জানতে চাইলে সে ক্ষমা চায় এবং বলে, দেশে এসে আমাকে বিয়ে করবে।’
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রফিক ওমান থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর বিমানবন্দর থেকে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ফতেরকান্দি গ্রামের বাড়িতে চলে যান রফিকুল। সেঁজুতির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে নানা ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন রফিকুল। এসব ঘটনায় একাধিকবার যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালেও সেঁজুতির মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিরিয়াস ক্রাইমে যোগাযোগ করলে ৩১ মার্চ যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ তার মামলা নেয়। মামলা নম্বর-১৬৭।
সেঁজুতি ও ওমানে প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে, গার্মেন্টকর্মী, এমনকি বিধবা নারীদের টার্গেট করে অনেক টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে ওমানে পাচার করা হয়। এ জন্য দালালের মাধ্যমে টার্গেট নারী বা তাদের পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা ওমানের নাগরিকদের টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে কফিল বানায়। এরপর তাদের গৃহকর্মীর চাহিদার কথা উল্লেখ করে ভিসা তৈরি করে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এভাবেই সেঁজুতিরও ভিসা পাঠানো হয়েছিল। ওই ভিসা অনুযায়ী তার বিএমইটি কার্ড করে দেয় রাজধানীর পল্টনের এম/এস আলবি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আল-আমিন নামে একজন সিআইডি কার্যালয়ে জানান, তারা শুধু টাকার বিনিময়ে বিএমইটি কার্ড প্রসেস করেছেন। কোথা থেকে ভিসা এসেছে বা কার কাছে কাজের জন্য যাচ্ছেন সে সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। বছর দুয়েক আগে দেশে ‘টিকটক কালচার’ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এই অনলাইন সামাজিক মাধ্যমের মোহে পড়তে শুরু করে উঠতি বয়সী মেয়েরা। আর এ সুযোগ নেয় নারী পাচারে সক্রিয় পুরনো এই চক্র। কারণ টিকটক গ্রুপের অ্যাডমিনদের মাধ্যমে অনলাইনে সহজেই হ্যাং আউট বা পুল পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। দুই বছর ধরে এভাবে তারা টিকটক গ্রুপের নারী সদস্যদের ছলেবলে বিদেশে শুটিং-অডিশনের কথা বলে পাচার করছে। বিশেষ করে ভারতে। এবার ওমানে পাচারেরও তথ্য পাওয়া গেছে। সেঁজুতি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘রফিকুলের সঙ্গে আমার ফেসবুকে পরিচয়।
সেখানে নিয়মিত কথা হতো। একপর্যায়ে সে আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখাতে থাকে। সে ওমানে থাকত। সে আমাকে ওমান যেতে বলে। সে বলে, আমি যদি ওমান যাই সে আমাকে বিয়ে করবে এবং ভালো কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তার কথায় আমি রাজি হই।’ ১৪ ফেব্রুয়ারি র্যাব-১ জানায়, নারী পাচার চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে তারা। এরা গার্মেন্ট ও বেসরকারি কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে গত আড়াই বছরে দুবাই, সৌদি আরব ও ওমানে ৮০ জন নারীকে পাচার করেছে। দুবাইয়ে বসে মহিউদ্দিন ও শিল্পী নামের দুজন চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের হয়ে দেশে কাজ করতেন গ্রেফতার আজিজুল হক, মোছলেম উদ্দিন ও কাউছার। বিদেশে যেতে টাকা লাগে। সেখানে উল্টো নারীদের ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে নিজ খরচে ভিসা ও পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেন চক্রের সদস্যরা।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন