মশিউর রহমান সাদ্দাম। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়া অবস্থায় রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ভ্যানে করে গেঞ্জি বিক্রি করতেন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি ফেসবুকে একটি পেজ খুলে নাটোর থেকে সবজি, দুধসহ বিভিন্ন পণ্য এনে বিক্রি করতেন। ২০১৯ সালে শুরু করেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আকাশনীল লিমিডেট। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি ছাড়ে পণ্য বিক্রির প্রলোভনে গ্রাহককে আকৃষ্ট করে। তবে অনেককে পণ্য না দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
র্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠানটি তিন দফায় ৯ হাজারের বেশি গ্রাহককে আকৃষ্ট করে হাতিয়েছে প্রায় ৩২ কোটি। এই ঘটনায় আকাশনীলের এমডি মশিউর রহমান সাদ্দাম গ্রাহককের টাকা ফেরত না দিয়ে ধানমন্ডিতে কেনেন তিন কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট। চড়তেন ৬০ লাখ টাকার দুটি গাড়িতে। প্রতিমাসে কর্মচারীদের বেতন দিতেন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।
এর আগে গতকাল রাতে রাজধানী ও ফরিদপুরে পৃথক অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান সাদ্দাম ও পরিচালক ইফতেখার উজ-জামান রনি।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-২ এবং র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে ফরিদপুর অভিযান চালিয়ে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ২টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ ও ১টি প্রাইভেটকার।
কমান্ডার মঈন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ অধ্যয়নকালেই দুই বন্ধু (মশিউর ও রনি) মিলে গার্মেন্টেসের ঝুট ব্যবসায় নামেন। গার্মেন্টসের রিজেক্টেড পণ্য বিক্রি করতেন নিউমার্কেটে। এরপর ২০১৯ সালে আকাশনীল নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করেন। ট্রেড লাইসেন্সও নেন। রাজধানীর কাঠাল বাগান এলাকায় অফিস নেন। প্রথমে শাক-সবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করেন।
করোনায় সুবিধা করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরপরই শুরু করেন প্রতারণামূলক ব্যবসা। আকাশনীল কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেন তারা। পুরো পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো ডিসকাউন্ট অফারে মোটরসাইকেল বিক্রির রমরমা ব্যবসা শুরু করেন। তিন দফায় তারা ৯ হাজারের বেশি গ্রাহককে আকৃষ্ট করে হাতিয়ে নেন প্রায় ৩২ কোটির বেশি টাকা।
গত সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা পণ্য অথবা টাকা ফেরতের চাপ দিতে শুরু করলে অফিস গুটিয়ে নেন। নিজেদের ফোন বন্ধ রাখেন। এক পর্যায়ে দুবাই যাবার জন্য ভিসাও করেন এমডি মশিউর।
মশিউর মূলহোতা:
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আকাশ নীলের কারসাজির মূলহোতা গ্রেপ্তার মশিউর। তিনি ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে জানান, তার মাথায় অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসলে অ্যামাজন, আলীবাবার মত অনলাইনে ব্যবসার করার ইচ্ছা হয়। এরপর ২০১৯ সালে আকাশনীল কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করে এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেন। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঁঠাল বাগান এলাকায় একটি অফিস নিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেয়ার ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
পরবর্তীতে মশিউরকে বিভিন্নভাবে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অর্থ নিয়ে তার কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঁঠাল বাগান থেকে পান্থপথে অফিস স্থানান্তর করেন। তার লিমিটেড কোম্পানি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসা যাতে তার নিজের নামে ৭৭ শতাংশ, বোনের নামে ১০ শথাংশ, মায়ের নামে ৮ শতাংশ এবং তার স্ত্রীর নামে ৫ শতাংশ শেয়ার রাখেন। তার এই পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবসায় নিজে ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মা চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধু ইফতেখাইরুজ্জামান রনি ছিল পরিচালক।
ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অফারে মোটরসাইকেরের রমরমা ব্যবসায় অনুপ্রানিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে অফারে মোটরসাইকেল বিক্রির মাধ্যমে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। তাদের ১ম ক্যাম্পেইন ছিল গত মে মাসে। সেসময় ৩০ শতাংশ ছাড়ে ২ মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে দুই শতাধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পান।
গত বছরের জুলাই মাসে ২৫ শতাংশ ডিসকাউন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় এক হাজারের অধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পান। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে মোটরসাইকেলের ৩য় ক্যাম্পেইনে ২৩ শতাংশ ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে সরবরাহের আশ্বাসে ৯ হাজারের অধিক মোটর সাইকেলের অর্ডার পান। মোটরসাইকেলের পাশাপাশি তারা লোভনীয় ছাড়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স পন্য, গৃহস্থলির অন্যান্য পন্য বিক্রি নিয়েও অফার দেন।
গত সেপ্টেম্বর এ ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা পণ্য অথবা টাকা রিফান্ডের জন্য চাপ দেয়া শুরু করেন। গ্রাহকদের চাপে গত নভেম্বরে গ্রেফতার মশিউর অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।
কমান্ডার খনদকার আল মঈন আরও বলেন, তাদের অফার ব্যবসায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ছিল তবে শেষ ক্যাম্পেইনে ছাত্র বা যুব সমাজের গ্রাহকরাই মোটর সাইকেলের অফারটি গ্রহণ করেছিল। গ্রাহকদের টাকা সরাসরি মশিউরের নিজের ব্যাংক একাউন্টে জমা হতো। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসার মত গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো। ই-কমার্স নীতিমালার কারণে পণ্য ডেলিভারি না হলে টাকা গেটওয়েতে আটকে থাকার কারণে সেসব টাকা গ্রাহকদের রিফান্ড করা হতো। সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে প্রদানকৃত অর্থ নিয়ে তারা প্রতারণা করতো।
র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যা জানা যায়:
আকাশ নীল লিমিটেড কোম্পানিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী ছিল। যাদের মাসিক ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা বেতন দেয়া হতো। গ্রাহকের টাকায় ধানমন্ডিতে তিন কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন। রয়েছে প্রিয়াশ ও সিএইচআর মডেলের দুটি দামি গাড়ি। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ৪টি টাটা পিকআপ রয়েছে।
গ্রাহকের কাছে আকাশনীলের দেনা প্রায় ৩২ কোটি টাকা:
বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে দেনা প্রায় ৩২ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ৪টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। এই দায় মেটানোর কোনো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তারা। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি। কোন ব্যবসায়িক লাভ ছিল না, উল্টো ছিল খরচ। যা গ্রাহকের টাকায় মেটানো হত। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। তবে ব্যবসায়িক বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরী হয় এ ধরণের পণ্যকে বেছে নেয়, যেমন- মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক, গাড়ি ও গৃহস্থলীপণ্য।
পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের বিশাল আকারে দায় তৈরী হয়। সে দেনা না মিটিয়ে ব্যবসায়িক অপকৌশল হিসেবে নতুন গ্রাহকের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক পরিশোধ করা। অর্থাৎ ‘দায় ট্রান্সফার’ এর মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল আকাশনীল প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরী হত, দায় তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রেফতার মশিউর জেনেশুনেই নেতিবাচক এগ্রেসিভ পলিসিতেই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। আকাশনীল পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্র। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে ক্রমান্বয়ে দায় বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়। আকাশনীলের নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটিজির কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ট্রানজেকশন গেটওয়ে আকাশনীল থেকে সরে আসে।
দুবাই পালানোর পরিকল্পনা মশিউরের:
ব্যবসায়িক দায় ও লাভ না হওয়ায় ব্যবসা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন মশিউর ও রনি। সম্প্রতি মশিউর দুবাই পালানোর জন্য ভিসা ও বিমান টিকিটও ক্রয় করেন। তার আগেই গ্রেফতার হন মশিউর ও সহযোগী পরিচালক রনি।
সূত্র : ঢাকাটাইমস