গুলশানে ফ্ল্যাটে মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যু এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গত সোমবার (২৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বরের ১২০ নম্বর সড়কের ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই রাজধানীর গুলশান থানায় ৩০৬ ধারায় ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়া’র অভিযোগে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর বিরুদ্ধে মামলা করেন মোসারাতের বড় বোন নুসরাত জাহান। মামলা নম্বর২৭। এরপরই এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। এরইমধ্যে আদালত সায়েমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
তবে সায়েম সোবহান আদৌ দেশে আছেন কি না, তা নিয়েও এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
যদিও পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেছেন, ‘সায়েম সোবহান দেশের বাইরে চলে গেছেন কিনা, এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশনে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সায়েম দেশের বাইরে যাননি।’
এদিকে ছোটবোনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলার বাদী নুসরাত জাহান গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন। এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে মুনিয়ার সঙ্গে তার শেষ কথোপকথন ও বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির সঙ্গে মুনিয়ার প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত জানান তিনি।
মুনিয়া আত্মহত্যার দিন সকালে অর্থাৎ গত সোমবার সকালেই বোনকে ফোনে বিপদের আভাস দিয়েছিলেন- এ কথা উল্লেখ করে নুসরাত জাহান বলেন, ‘সোমবার সকাল বেলা লাস্ট কথা হয়েছে। ওইদিন ও আমাকে ফোন করে, ওর ফোনের কান্নায় আমার ঘুম ভাঙে। ও ফোন দিয়ে বলে- আপু আমাকে ধোকা দিয়েছে, আপু আনভীর আমাকে ধোকা দিয়েছে। সে আমায় বলে- আপু আমি অনেক বিপদে আছি, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। আমি তাকে বুঝাই, বলি- তুমি একটু রেডি হও, তোমাকে এসে নিয়ে যাচ্ছি। কুমিল্লা নিয়ে আসবো। পরে ও বলে- আমি তো তোমার সাথে অভিমান করে চলে আসছি, এখন কীভাবে আসবো। ওর লজ্জা কাজ করছিল তো, আমি ওকে নরমাল করি। সোমবার বেলা ১১টার দিকে ও আমাকে কল করে বলে, আপু আমার অনেক বিপদ, তুমি কখন আসবা। যেকোনও সময় কিছু একটা হয়ে যাবে আপু।’
মুনিয়ার বোন আরও বলেন, ‘যাওয়ার পর ওরে অনেকবার কল করেছি ও ধরেনি। সেখানে গিয়াও ওরে যখন পাচ্ছিলাম না তখন বাসার মালিকের ওয়াইফকে কল করি। সে জানায় এক্সট্রা কোনও চাবি নাই। পরে মালিক আমাকে পরামর্শ দেন মিস্ত্রি এনে তালা ভাঙার। যখন তালা ভাঙতেছি তখনো ওর কোনো আলাপ না দেখে আমরা ভয় পাই। ও কোনো রেসপন্স করতেছে না, আমরা ভয় পাচ্ছি কি হচ্ছে কি হচ্ছে, তালা ভেঙে দেখি ও ঝুলন্ত। এরপর পুলিশকে কল করি, পুলিশ আসে ইফতারের পর।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ আসার পর উপরে যাই। যাওয়ার পর দেখলাম ও ঝুলন্ত অবস্থায় আছে কিন্তু তার পা বিছানায়। পা দুটা হালকা বিছানায় বাঁকা। বিছানা খুব পরিপাটি ছিল, বিছানায় যদি সেই শুইতো বা উঠে দাঁড়াতো একটু সিন্ড্রম, মানে খুব পরিপাটি ছিল। একটা সিট ছিল সেটাও পরিপাটি ছিল। পরে পুলিশ ওর লাশ নিচে নামায়।’
নুসরাত জাহান আরও বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার সঙ্গে ওর বাকবিতণ্ডা হয়। আমি ৫ দিন ওর সঙ্গে কথাও বলিনি। সে ঢাকায় যাবে, সে বাসা নেবে। ইন্টার পরীক্ষাও দিবে আমাকে খুশি করতে বলছে। আনভীর ওকে বিয়েও করবে। বলতেছে আপু এটা কাউকে বলা যাবে না, আনভীর নিষেধ করছে। আমি বলছি এটাতো আমি রাজি না, এটা হয় না। এটা কীভাবে হবে? বলে যে না কিছুদিন গোপন রাখতে হবে বলছে, বিয়ে করে। বিয়ে করে পরে বাইরে নিয়ে স্যাটেল করবে। আমি ওকে বোঝাতে পারিনি। আসলে আনভীরকে অনেক ভালোবাসতো সে।’
মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করতে বাধ্য ছিল। সব কিছু প্রমাণ ছিল ওই বাসায়। আমার বোনের সাথে ছবি, ও প্রতিনিয়ত ওই বাসায় যেত। তাকে নিয়ে অগণিত লেখা, ছবি আঁকতো, সব কিছু হাতে। তার মোবাইলে অনেক কিছু আছে, যা পুলিশের কাছে। কী কী করেছে ডায়েরিতে সব লিখেছে।’
চলচ্চিত্র অভিনেতা বাপ্পির সঙ্গে মুনিয়ার সম্পর্কের গুঞ্জন প্রসঙ্গে নুসরাত বলেন, ‘এগুলো কেউ রটাচ্ছে। পুরোপুরি মিথ্যে কথা। পরিচয় থাকতেই পারে, এর মানে এটা না। আমার কথা হচ্ছে আমার বোন চলে গেছে। এখন ওর চরিত্র নিয়ে অনেক কিছু আসবে আমি এটা জানি। আমার বোন মারা গেছে, মানে আমার সন্তান মারা গেছে। এখানে তার চরিত্র কি ছিল, তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রমাণ করুক কেউ, ওর চরিত্র খারাপ ছিল।’
নুসরাত আরও বলেন, ‘ও মরে গেছে। এ রমজান মাসে ওরে মাইরা ফেলছে, না হয় মরে গেছে, না হয় বাধ্য করছে। যেটাই করুক ওইটারই বিচার চাই। যেই করেছে আমি চাই বিচার হোক। আমি আপনাদের মাধ্যমে এটা সরকারকে বলতে চাই।’
বোনের আত্মহত্যা নিয়ে ‘সন্দেহ’ পোষণ করে নুসরাত বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এটা হত্যা। ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছিল। তাহাজ্জত পড়তো, পাঁচ ওয়াক্ত যে নামাজ পড়ে সে কীভাবে সুইসাইড করে? যদি সুইসাইড করেও থাকে এমন কিছু অপমানজনক করা হয়েছে যা সে নিতে পারেনাই। এখানে অনেক সিন্ড্রোম ছিল যে মার্ডার করা হয়েছে। আমার মনে হয় না, সে সুইসাইড করতে পারে। আমরা তো ঝুলন্ত পেয়ে আত্মহত্যা ভাবছি। পরে মাথায় আসলো একটা মানুষ যদি ঝুলে যায়, তার পা ছটফট করে তাহলে তো সিটটা নিচে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সিটটা তো সাজানো ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এটা সাধারণ সেন্সের ব্যাপারে। যেটা তখন আমার হিতাহিত জ্ঞানে আসেনি। পরে আমি সেটা ভেবেছি। সেখানে সব পরিপাটি ছিল। আমি ও পুলিশ সেগুলো অবজার্ভ করেছি। পুলিশও শতভাগ বলতে পারবে না যে এটা সুইসাইড ছিল। ওনারা এ রকম অনেক কেস ডিল করেন, আমার চেয়ে ওনারা বেশি অভিজ্ঞ। হয়তো তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।’
ভাইরাল হওয়া একটি অডিও রেকর্ডে ৫০ লাখ টাকা বিষয়ে মুনিয়া ও সায়েম সোবহানের কথোপকথন শোনা যায়। মুনিয়া কোনও টাকা নিয়েছিল কিনা- এমন প্রশ্নে নুসরাত বলেন, ‘টাকার বিষয়টা শোনার পর ধারণা করেছি, বিয়ের কথা আসায় আনভীর এমন ব্লেম দিয়েছে। যেন মুনিয়া চলে আসে। এটা হতে পারে। তবে আমার বোন টাকা নেয়নি। সে আনভীরকে ভালোবাসতো। তাকে ফুঁসলিয়ে ঢাকায় নেয়া হয়েছে।’
নুসরাত বলেন, ‘আমায় একটা নাম্বার থেকে ফোন করে টাকার জন্য। আমাকে অনেক নোংরা কথা বলেছে। আমি নাকি আনভীরকে ফাঁসাতে মুনিয়াকে ব্যবহার করেছি। আমি নাকি মুনিয়াকে দিয়ে ব্যবসা…। ফোনে আমাকে বলে, এখন মিডিয়া করতেছি, কথা বলতেছি, এগুলো নাকি টাকা নেয়ার জন্য করতেছি। ফোনে আমাকে বলে, বোনকে দিয়ে বিজনেস করানোর জন্য আমি নাকি আনভীরকে ফাঁসাচ্ছি। এরপর আমি ফোন কেটে দিই।’
মুনিয়ার বোন আরও বলেন, ‘আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অনেক সৎ ছিলেন। আমাদের শহরের সবাই জানে ওনারা কেমন ছিলেন। ওনারা নেই, ওনাদের সন্তান, এতিম একটা মেয়ে। তার সাথে যা হয়েছে, আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চাই। বাংলাদেশে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি, তাঁর কাছে আমার সন্তানের মতো বোনের অপমৃত্যুর বিচার চাই। সে (সায়েম) হয়তো অনেক বড় কিছু… তাই বলে কি বিচার পাবো না? আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটা ছাড়া আর কোনও কিছু চাওয়ার নাই (বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন বোন হারানো নুসরাত)।