প্রতি বছর কোটি কোটি মুসলমান রোজা রাখেন সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারে বিরত থেকে। কয়েক বছর ধরে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে রোজা পড়েছে গ্রীষ্মকালে। ফলে এসব দেশের মুসলিমদের রোজা রাখতে হচ্ছে গরমের মধ্যে অনেক দীর্ঘসময় ধরে। ইউরোপের কোনও কোনও দেশে কুড়ি ঘণ্টাও রোজা রাখতে হচ্ছে।কিন্তু মুসলিমরা যে একমাস ধরে রোজা রাখেন, সেটা তাদের শ’রীরে কী প্রভাব ফেলে?
প্রথম কয়েকদিন: সবচেয়ে ক’ষ্টকর শেষবার খাবার খাওয়ার পর আট ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু মানুষের শ’রী’রে সেই অর্থে রোজার প্রভাব পড়ে না।আমরা যে খাবার খাই, পাকস্থলীতে তা পুরোপুরি হজম হতে এবং এর পুষ্টি শোষণ করতে অন্তত আট ঘণ্টা সময় নেয় শ”রীর।
যখন এই খাদ্য পুরোপুরি হজম হয়ে যায়, তখন আমাদের শ’রীর য’কৃ’ৎ এবং মাং’সপেশীতে সঞ্চিত থাকে যে গ্লুকোজ, সেটা থেকে শক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে।শ’রীর যখন এই চর্বি খরচ করতে শুরু করে, তা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি কো’লে’স্টে’রলের মাত্রা কমায় এবং ডা’য়াবে’টি’সের ঝুঁকি’ কমায়।
তবে যেহেতু রক্তে সুগার বা শর্করার মাত্রা কমে যায়, সে কারণে হয়তো কিছুটা দুর্বল এবং ঝিমুনির ভাব আসতে পারে।এছাড়া কারও কারও ক্ষেত্রে মাথাব্যা’থা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা নিশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে।এ সময়টাতেই আসলে শ’রীরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা লাগে।
৩ হতে ৭ রোজা: পানিশূন্যতা থেকে সাবধানপ্রথম কয়েকদিনের পর আপনার শ’রীর যখন রোজায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন শ’রীরে চর্বি গলে গিয়ে তা রক্তের শর্করায় পরিণত হচ্ছে।কিন্তু রোজার সময় দিনের বেলায় যেহেতু আপনি কিছুই খেতে বা পান করতে পারছেন না, তাই রোজা ভাঙার পর অবশ্যই আপনাকে সেটার ঘাটতি পূরণের জন্য প্রচুর পানি পান করতে হবে।
নইলে আপনি মারাত্মক পানি-শূন্যতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষ করে গরমের দিনে যদি শ’রীরে ঘাম হয়।আর যে খাবার আপনি খাবেন, সেটাতেও যথেষ্ট শক্তিদায়ক খাবার থাকতে হবে। যেমন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা এবং চর্বি।একটা ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সব ধরনের পুষ্টি, প্রোটিন বা আমিষ, লবণ এবং পানি থাকবে।
৮ হতে ১৫ রোজা: অভ্যস্ত হয়ে উঠছে শ’রীরএই পর্যায়ে এসে আপনি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছেন যে আপনার শ’রীর-মন ভালো লাগছে, কারণ রোজার সঙ্গে আপনার শ’রীর মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।ক্যামব্রিজের এডেনব্রুকস হাসপাতালের `অ্যানেসথেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের` কনসালট্যান্ট ড. রাজিন মাহরুফ বলেন, এর অন্যান্য সুফলও আছে।
“সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খাই এবং এর ফলে আমাদের শ’রী’র অন্য অনেক কাজ ঠিকমত করতে পারে না, যেমন ধরুন শ’রীর নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে।”
“কিন্তু রোজার সময় যেহেতু আমরা না খেয়ে থাকছি, তাই ‘শ’রীর তখন অন্যান্য কাজের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। কাজেই রোজা কিন্তু শ’রীরের জন্য বেশ উপকারী। এটি শ’রীরের ক্ষত সারিয়ে তোলা বা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করতে পারে।”
১৬ হতে ৩০ রোজা: ভারমুক্ত শ’রীররমজান মা’সের দ্বিতীয়ার্ধে আপনার শ’রীর কিন্তু পুরোপুরি রোজার সঙ্গে মানিয়ে নেবে।আপনার শ’রীরের পা’চক’তন্ত্র, য’কৃৎ, কিডনি এবং দেহত্বক এখন এক ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে। সেখানে থেকে সব দূ’ষিত বস্তু বেরিয়ে আপনার শ’রীর যেন শুদ্ধ হয়ে উঠবে।
“এসময় আপনার শ’রী’রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের পূর্ণ কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। আপনার স্মৃতি এবং মনোযোগের উন্নতি হবে এবং আপনি যেন শ’রীরে অনেক শক্তি পাবেন”, বলছেন ড. মাহরুফ।
“শ’রীরের শক্তি জোগানোর জন্য আপনার আমিষের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। যখন আপনার শ’রী’র ‘ক্ষুধার্ত’ থাকছে তখন এটি শক্তির জন্য দেহের মাং’সপেশীকে ব্যবহার করছে এবং এটি ঘটে যখন একটানা বহুদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনি উপোস থাকছেন বা রোজা রাখছেন।”
“যেহেতু রোজার সময় কেবল দিনের বেলাতেই আপনাকে না খেয়ে থাকতে হয়, তাই আমাদের শ’রীরের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার এবং তরল বা পানীয় গ্রহণের সুযোগ থাকছে রোজা ভাঙার পর। এটি আমাদের মাং’সপেশীকে রক্ষা করছে এবং একই সঙ্গে আমাদের আবার ওজন কমাতেও সাহায্য করছে।”
তাহলে রোজা রাখা কি স্বাস্থ্যের জন্য ভাল?ড. মাহরুফ বলেন, অবশ্যই, তবে একটা ব্যাপার আছে।“রোজা রাখা শ’রীরের জন্য ভালো, কারণ আমরা কী খাই এবং কখন খাই সেটার ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। একমা’সের রোজা রাখা ভালো। কিন্তু এর চেয়ে বেশি একটানা রোজা রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যাবে না।
“শ’রীরের ওজন কমানোর জন্য একটানা রোজা রাখা কোনও উপায় হতে পারে না। কারণ একটা সময় আপনার শ’রীর চর্বি গলিয়ে তা শক্তিতে পরিণত করার কাজ বন্ধ করে দেবে। তখন এটি শক্তির জন্য নির্ভর করবে মাং’সপেশীর ওপর। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কারণ আপনার শ’রীর তখন ক্ষুধায় ভুগ’বে।”
ড. মাহরুফের পরামর্শ হচ্ছে, রমজান মা’সের পর মাঝে মধ্যে অন্য ধরনের উপোস করা যেতে পারে। যেমন ৫:২ ডায়েট (পাঁচদিন কম খেয়ে দুদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করা)। যেখানে কয়েকদিন রোজা রেখে আবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে।