লিয়াকত-নাজিম ফোনালাপে সিনহা খুনের রহস্য!

অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে ও পরে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই লিয়াকতের সঙ্গে নাজিম উদ্দিনের রহস্যজনক ফোনালাপের তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ গুলি করার পর যাদের সাক্ষী দেখায় তাদের মধ্যে নাজিম উদ্দিন অন্যতম।

এরই মধ্যে নাজিমসহ পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। লিয়াকত-নাজিম ফোনালাপের মধ্যে খুনের মোটিভ লুকিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি চ্যানেল যমুনা টিভির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

সূত্র জানায়, ঘটনার দিন সোয়া ৯টার দিকে শামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্টে তল্লাশি করতে থাকে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম।

এর ২০ মিনিট পর এখানে আসে সিনহা ও সিফাতের সাদা প্রাইভেট কারটি। এরপরই ঘটে গুলির ঘটনা। কিন্তু যমুনা টেলিভিশনের হাতে আসা পরিদর্শক লিয়াকতের কললিস্ট বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, উল্লিখিত সময়ের পুরোটা ফোনে কথা বলেছেন লিয়াকত।

এই সময়টায় তিনি বেশি ব্যস্ত ছিলেন নাজিম উদ্দিন নামে একজনের সঙ্গে কথা বলতে। এই নাজিম পুলিশের করা হত্যাচেষ্টা মামলার তিন সাক্ষীর একজন। ওইদিন পরিদর্শক লিয়াকতের সঙ্গে নাজিমের রহস্যজনক যোগাযোগের তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা।

সেই রহস্যের কূলকিনারা করতেই পুলিশের মামলার তিন সাক্ষীকে আসামি দেখিয়ে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

কললিস্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে একটি রবি নম্বর থেকে কল আসে লিয়াকতের ফোনে; কথা হয় ৬৪ সেকেন্ড। ওই নম্বরটি নাজিমের। এর ঠিক দশ মিনিট পর ৮টা ৫৭ মিনিটে নাজিম আবার ফোন দেন লিয়াকতকে।

এরপর রাত নয়টা থেকে বাড়তে থাকে তাদের যোগাযোগ। নয়টা দুই মিনিটে লিয়াকত ফোন দেন তার ফাঁড়ির মুন্সি আরিফকে। এরপর ৯টা ৪ মিনিটে নাজিম আবার ফোন দেন লিয়াকতকে। ৯টা ১২ এবং ৯টা ১৮ মিনিটেও নাজিম ফোন দেন লিয়াকতকে।

এবার ৯টা ২৫ ও ২৬ মিনিটে লিয়াকত দু’বার ফোন দেন নাজিমকে। প্রতিবারই তারা এক থেকে দেড় মিনিট করে কথা বলেন। পরের চার মিনিট আর কল আসেনি লিয়াকতের ফোনে। রাত সাড়ে ৯টায় ওসি প্রদীপকে কল দেন লিয়াকত।

এর তিন মিনিট পর ৯টা ৩৩ মিনিটে লিয়াকত আবার কল দেন তার ফাঁড়ির মুন্সি আরিফকে। মামলার এজাহার অনুযায়ী ঠিক এই সময়টায় গুলির ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে মুন্সি আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গুলি করার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি গুলির পর লিয়াকত তাকে ফোন দিয়ে কিছুই বলেননি।

তদন্তকারীদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য যে, গুলির ঘটনার মুহূর্তে লিয়াকত নিজের মুন্সিকে ফোন দিয়ে ঝামেলার কথা উল্লেখই করেননি। আরিফের সঙ্গে কথা বলার পর ৯টা ৩৪ মিনিটে লিয়াকত ফোন দেন পুলিশ সুপার বিএম মাসুদকে।

সেখানে সিনহাকে গুলি করার বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানান লিয়াকত। বলেন, ‘একজনকে ডাউন করেছি। আরেকজনকে ধরে ফেলেছি। আমার দিকে অস্ত্র তাক করা হয়েছিল। তাই আমি গুলি করেছি।’

জবাবে এসপি বলেন, ‘তোমাকে গুলি করা হয়েছিল। সেটি তোমার গায়ে লাগেনি। আর তুমি যে গুলি করেছ, সেটা তার গায়ে লেগেছে। ঠিক আছে।’ ৯টা ৩৯ মিনিটে আবার পুলিশ সুপার লিয়াকতকে ফোন দেন।

এরপর মধ্যরাত পর্যন্ত লিয়াকতের ফোন ব্যস্ত ছিল পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসি প্রদীপ, জেলার ডিবির ওসির সঙ্গে কথোপকথনে। এর মধ্যেও সময়ে সময়ে লিয়াকতের ফোনে উপস্থিত হয়েছেন সেই নাজিম।

রাত ১০টা ১৩ মিনিট থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের মধ্যে পাঁচবার কথা হয়। এর মধ্যে ১০টা ৩৬ মিনিটে নাজিম ফোন দেন লিয়াকতকে, ১১টা ৭ মিনিটে লিয়াকত ফোন দেন নাজিমকে।

১১টা ১১ মিনিট ও ১১টা ১৩ মিনিটে লিয়াকতকে দু’বার এসএমএস করেন নাজিম। এরপর ১১টা ৪২ মিনিটে নাজিম দু’বার লিয়াকতকে ফোন করেন। ১১টা ৪৫ মিনিটে লিয়াকত ফোন করেন নাজিমকে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন পুলিশের মামলায় তিন সাক্ষী সিনহা হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।

তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যেসব অভিযোগ এসেছে, সবই আমাদের নজরে রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করছেন।