সাধারণত আমরা তিনবেলা খাবার খেয়ে থাকি। দুইবেলা খাবারের মাঝে বিরতির মেয়াদ যদি অনেকটাই বেশি থাকে কিংবা পরিশ্রম করার পর দ্রুত খেলেও বদহজম-গ্যাস্ট্রিকের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। আর ওই বিরতির পরে যদি ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার খাওয়া হয় তাহলে শরীরের আরও ক্ষতি হয়। অনেক সময় বদহজমের কারণে শরীর নিয়ন্ত্রণের বাইলে চলে যায়। যেহেতু এটা পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে ঘটে থাকে। বদহজম কিংবা গ্যাস্ট্রিক থেকে বাঁচতে হলে পরিপাকতন্ত্র সম্বন্ধে জানতে হবে।
পরিপাকতন্ত্রের রোগ হলো গ্যাস্ট্রিক-আলসার, বদহজম, এসিডিটি ইত্যাদি। পেটের মধ্যে অবস্থিত পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অংশ হলো খাদ্যনালীর নিচের ভাগ, পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র। পরিপাকতন্ত্রের মূল কাজ হলো আমরা যেসব খাবার খাই, তা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য রসের মাধ্যমে ভেঙে হজম করানো। হজম এর অর্থ হলো জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার ভেঙে ছোট ছোট অংশ হিসেবে পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করা।
বদহজম-গ্যাস্ট্রিক হলেই গলা জ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর, বুকে-পিঠে ব্যথা, মাথায় যন্ত্রণার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার ফলে ঠিক মতো প্রাতরাশ অনেকেই করেন না। সেটিও বদহজমের বড় কারণ। সে ক্ষেত্রে সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে ভারী ব্রেকফাস্ট করে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ডিনারের পরেও হালকা হাঁটাচলা, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ় করলে হজমের সুবিধে হয়। তবে এ সবই হচ্ছে সমস্যার আগের সতর্কতা। কিন্তু বদহজম, গ্যাস্ট্রিক হলে কী করবেন। দ্রুত অরোগ্যের জন্য বাসি, পচা ও তৈলাক্ত খাবার বর্জন করুন। বদহজম-গ্যাস্ট্রিক সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান হলো প্রাকৃতিক কিছু খাবার যা থেকে আপনি পরিত্রাণ পেতে পারেন।
আমলকী
আমলকি সন্ধ্যায় পানিতে ভিজিয়ে রাখুন সকালে খলিপেটে একগ্লাস পান করুন। এভাবে চলতে থাকলে গ্যাস্ট্রিক একসময় ভালও হয়ে যাবে। বদহজম, সানবার্ন, সানস্ট্রোক থেকে রক্ষা করে। পেটের জ্বালা জ্বালাভাব কম রাখে। লিভারের কার্যকলাপে সাহায্য করে, পাইলস সমস্যা কমায়। এক গ্লাস দুধ বা পানির মধ্যে আমলকী গুঁড়ো ও সামান্য চিনি মিশিয়ে দিনে দু’বার খেতে পারেন। এ্যাসিডিটির সমস্যা কম রাখতে সাহায্য করবে। আমলকী হজমে সাহায্য করে ও স্টমাক এ্যাসিডে ব্যালেন্স বজার রাখে। আমলকী লিভার ভাল রাখে।
বেকিং সোডা
বেকিং সোডা পেটের অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক রেহাই পেতে সাহায্য করে। ১ গ্লাস পানিতে ১/৪ চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে পান করুন। ভালো ফলাফল পাবেন। বেকিং সোডা একটি অম্ল নাশক বিধায় গ্যাস্ট্রিক বা হার্ট বার্ন এবং পেটের এসিড জাতীয় কারণে জালা পোড়া করা বা বদ হজমে বিশেষ কার্যকর – সাধারণত ১/২ চামচ বেকিং সোডা এক গ্লাস পানির মধ্যে মিশিয়ে প্রতিদিন ৩/৪ বার খেতে পারেন যা খাবারের এক ঘন্টা পর খেতে হয় । ভরা পেটে খেলে কোন কাজ করেনা এবং কোন অবস্থায় ১৪ দিনের বেশী একনাগারে খাওয়া ঠিক নয়।
টক দই
টক দই হজমে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন ভারী খাবারের পর একগ্লাস করে খেতে পারলে আপনার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে। টক দইয়ের ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত উপকারী। এটা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। যারা দুধ খেতে পারেন না বা দুধ যাদের হজম হয় না, তারা অনায়াসেই টক দই খেতে পারেন। কারণ টক দইয়ের আমিষ দুধের চেয়ে সহজপাচ্য। ফলে স্বল্প সময়ে হজম হয়।
দারুচিনি
দারুচিনি হজমশক্তির জন্য অনেক ভাল একটি মশলা। এটি প্রাকৃতিক এনটাসিড হিসাবে কাজ করে থাকে এবং পেটের গ্যাস দূর করতে সাহায্য করে। এক কাপ পানিতে আধা চাচামচ দারুদিনি গুঁড়া মেশান। কয়েক মিনিট সেটি সিদ্ধ করুন। এটি দিনে ২/৩ বার পান করতে পারেন।
আপেল সিডার ভিনেগার
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক রেহাই পেতে এর জুড়ি নেই। ১ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে ২ টেবিল চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে পান করে ফেলুন। পাকস্থলী পীড়ায় কাতর! তাহলে পানিতে একটু আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিন। যে খাবারগুলো গ্রহণের পরে আপনার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা খাওয়ার আগে এক চুমুক আপেল সিডার খেয়ে নিন। প্রাচীন এই পন্থানুসরণ করতে পারেন- এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চা-চামচ মধু আর এক চা-চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খাবারের আধা ঘণ্টা আগে খেয়ে নিলে বদহজম থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
ডাবের পানি
ডাবের পানি খেলে হজম ক্ষমতা বাড়ে এবং সব খাবার সহজেই হজম হয়ে যায়। এছাড়াও গ্যাসের সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায় নিয়মিত ডাবের পানি খেলে। তাই সম্ভব হলে প্রতিদিন ডাবের পানি খাওয়ার অভ্যাস করুন। তাহলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। ডাবের পানিতে আছে প্রচুর পরিমাণে রিবোফ্লেবিন, নিয়াসিন, থায়ামিন পেরিডক্সিসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান। ডাবের পানি পান করলে হজম শক্তি বাড়ে ও বদহজম দূর হয় । ডাবের পানি বদহজম , গ্যাসট্রিক , আলসার , কোলাইটিস , ডিসেন্ট্রি এবং পাইলসের সমস্যায় দূরীকরণে সাহায্য করে।
পুদিনা পাতার রস
পুদিনা পাতার রস গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে বহুদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতিদিন পুদিনা পাতার রস বা পাতা চিবিয়ে খেলে এসিডিটি ও বদহজম থেকে দূরে থাকতে পারবেন। পুদিনা পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা পেটের যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে খুব দ্রুত। যারা হজমের সমস্যা এবং পেটের ব্যথা কিংবা পেটের নানান সমস্যায় ভুগে থাকেন, তারা খাবার খাওয়ার পর ১ কাপ পুদিনা পাতার চা খাওয়ার অভ্যাস করুন। ৬/৭টি তাজা পুদিনা পাতা গরম পানিতে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে খুব সহজে পুদিনা পাতার চা তৈরি করতে পারেন ঘরের মধ্যেই।
আদা
পেটে গ্যাসের সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ ঘরোয়া সমাধান হলো আদা খাওয়া। প্রতিবেলা খাবার খাওয়ার পর এক টুকরা আদা মুখে নিয়ে চিবিয়ে রস খান। তাহলে পেটে গ্যাস জমবে না এবং গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার থেকে মুক্তি মিলবে। যারা আদা সরাসরি খেতে পারেন না তাঁরা রান্নায় বেশি করে আদা ব্যবহার করুন। আদায় পানীয় লবণ মিশিয়ে পান করলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়।
জিরাপানি
এক চা চামচ জিরা নিয়ে ভেজে ফেলুন। এবার এটিকে এমন ভাবে গুড়া করুন যেন পাউডার না হয়ে যায়, একটু ভাঙা ভাঙা থাকে।এই গুড়াটি একগ্লাস পানিতে মিশিয়ে প্রতিবার খাবারের সময় পান করুন। দেখবেন কেমন ম্যাজিকের মতো কাজ করে। অ্যাসিডিটির সমস্যার জন্য ভালো জিরা পানি খুবই উপকারি। যেকোনো ভারী খাবার খাওয়ার পর ধীরে ধীরে জিরাপানি খেলে অ্যাসিডিটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পেটের গ্যাস কমাতে জিরা পানি সাহায্য করে।
প্রাকৃতিক চা
বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক চা যেমন সবুজ চা, পুদিনা চা, তুলসী চা এগুলো হজম ক্ষমতা বাড়ায় এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সমাধান করে।
লেবুর রস
একটি মাঝারি আকৃতির লেবু চিপে রস বের করে নিন। এরবার লেবুর রসের সাথে আধা টেবিল চামচ বেকিং সোডা ও এক কাপ পানি মিশিয়ে নিন।বেকিং সোডা ভালো করে মিশে যাওয়া পর্যন্ত নাড়ুন। এবার মিশ্রণটি খেয়ে নিন। নিয়মিত খেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় আরাম পাওয়া যায়। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় সাথে সাথে আরাম পেতে চাইলে হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে।