দিনের আলোয় কয়েক শ মানুষের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাতকে যখন সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছিল, তখন সাহায্যে মিন্নি ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেনি। স্বামীর জীবন বাঁচাতে নিজেই জীবন বাজি রেখেছিলেন সেদিন। তিনি প্রথমে আশপাশে দাঁড়ানো পথচারীদের উদ্দেশে ‘হেল্প হেল্প’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। কেউ এগিয়ে না এলে একাই সশস্ত্র যুবকদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালান। সশস্ত্র একজনকে জাপটে ধরে রাখলেও, অন্য দিক থেকে আরেকজন কোপাতে থাকে রিফাতকে। সেদিকে আবারও ছুটে যান মিন্নি। ধারালো অস্ত্রসহ জাপটে ধরে বাধা দেন। কিন্তু একা মিন্নি আর কজনকে বাধা দিয়ে রাখবেন? পারেননি তিনি। কয়েকজন মিলে কোপাতে থাকে রিফাতকে। প্রকাশ্যে রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। রিফাতকে বাঁচানো যায়নি। বরগুনা শহরের এ পৈশাচিক ঘটনার দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় এখন ভাইরাল। বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে যে মেয়েটি জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই তাকেই এখন মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। চোখের সামনে স্বামীকে খুন হতে দেখে মিন্নির জীবন যখন দুর্বিষহ, ঠিক তখনই তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নিরাপত্তার নামে তাকে রাখা হয়েছে নজরবন্দি। ভাইরাল হওয়া ফুটেজের নানা ব্যাখ্যা তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মিন্নির পরিবারের অভিযোগ, রিফাত হত্যাকান্ডে মিন্নির নেপথ্য কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে খুনিদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। বরগুনার বিশিষ্টজনেরা বলছেন, রিফাত শরীফের সব খুনিকে আগে আইনের আওতায় আনা হোক। মিন্নিকে দোষারোপ করা মানেই হলো খুনিদের কৌশলে রক্ষা করা। তারা খুনিদের গ্রেফতার করে বিচারের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। তবে পুলিশ বলছে, এটি একটি নারকীয় রোমহর্ষক হত্যাকা । মিন্নি এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী। কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে তদন্ত হচ্ছে না।
মিন্নির স্বজনদের অভিযোগ, রিফাত হত্যা মামলায় আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে মিন্নিকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ভাইরাল হওয়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ঘটনার আগে কলেজে রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডদের সঙ্গে মিন্নির সাক্ষাৎ, কথা, আচরণ অনুসন্ধান করে হত্যাকান্ডে র সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা খোঁজ করছে পুলিশ।
এদিকে মিন্নির বাড়িতে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন শুধু তার নিরাপত্তার কারণেই নয়, তাকে নজরবন্দি করার পর্যায়ে দেখছেন অনেকে। হত্যাকান্ডে র পরপরই একটি গ্রুপ মিন্নিকে হত্যাকান্ডে র ইন্ধনকারী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর করেছে। প্রকাশ্যে জীবন বাজি রেখে যে মেয়েটি স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালেন, তার তৎপরতা অভিনয় মনে করছেন কেউ কেউ।
গত শনিবার (৬ জুলাই) রিফাত হত্যাকান্ডে সিসিটিভি ক্যামেরার দুটি ফুটেজ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে মিন্নির ভূমিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। ভিডিওতে কলেজের প্রধান ফটক থেকে রিফাতকে নিয়ে মিন্নিকে বেরোতে দেখা যায়, পরে এদিকওদিক তাকিয়ে মিন্নি ফের কলেজের ভিতরে যান। এ সময় রিফাত শরীফ মিন্নিকে ভিতরে যেতে বাধা প্রদান করেন। এর পরই সন্ত্রাসীরা কলেজ গেট থেকে যখন রিফাতকে ধরে সামনের দিকে নিয়ে যায়, তখন মিন্নিকে পেছনে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে দেখা যায়। এর কয়েক সেকেন্ড পরই নয়ন বন্ড ও অন্যরা যখন কিল-ঘুষ, লাথি দিতে শুরু করে তখনই মিন্নি ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে শুরু করেন এবং কুপিয়ে জখম করার সময় কখনো রিফাত ফরাজী, কখনো নয়ন বন্ডকে আগলে ধরে ফেরানোর চেষ্টা করেন। কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে যাওয়ার পর রিফাত শরীফ হেঁটে রিকশায় ওঠেন। মিন্নি তখন ব্যাগ ও জুতা তুলে নিয়ে রিফাতকে খুঁজতে সামনে এগিয়ে যান। সিসিটিভি ফুটেজের এমন দৃশ্য দেখার পর কেন মিন্নি রিফাতকে কলেজের ভিতর নিয়ে যাচ্ছিলেন, সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কেন স্বাভাবিক হাঁটছিলেন এবং শেষ পর্যায়ে রিফাতের দিকে ছুটে না গিয়ে কেন জুতা ও ব্যাগ তুলতে গিয়েছিলেন- এমন নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে শুরু করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকে।
এসব বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার দুপুরে মিন্নির বাড়িতে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মিন্নি বলেন, ‘তখন সোয়া ১০টা। রিফাত আমাকে বলে, আব্বু আসছে, চল, তোমার সঙ্গে দেখা করবে। আমি ওকে বলছিলাম আমার কাজ শেষ করে বের হই। ও আপত্তি করে বলে, বাবা গেটে অপেক্ষা করছে। আমি তখন ওর সঙ্গে বের হই। গেটের বাইরে এসে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি ওর বাবা (মিন্নির শ্বশুর) কোথাও নেই। তখন আমি বলি, তুমি মিথ্যে বলেছ। চল রুটিন নিয়ে আসি। আমি ওকে নিয়ে ভিতরে যেতে চাই।’ মিন্নি বলেন, ‘ঠিক এ মুহূর্তেই ১০-১২ জন আমাদের ঘিরে ধরে ও রিশান ফরাজী ওর পথরোধ করে বলে, তুই আমার বাবা মা তুলে গালি দিছিস? ও বলে, না। তখন রিফাত ফরাজী এসে বলে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। ঠিক এ মুহূর্তে অন্য কয়েকজন বলে ওর কাছে অস্ত্র আছে, এই ধর ধর। বলেই সামনে নিতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব। ওদের পেছনে হাঁটতে থাকি। পরে যখন আক্রমণ করে তখন প্রতিরোধের চেষ্টা করি। আমি হেল্প চাই অনেকের কাছে, কেউ আসেনি। ওরা চলে যাওয়ার পর রিফাত নিজেই হেঁটে রিকশায় ওঠে। আমার পায়ের পাতা কেটে যাওয়ায় জুতা ছাড়া হাঁটতে পারছিলাম না। তখন জুতা পায়ে দিই। এ সময় একজন আমার হাতে আমার ব্যাগটি তুলে দেয়। পরে আমি দ্রুত গিয়ে রিফাতের রিকশায় উঠে ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাই।’ মিন্নি আরও বলেন, ‘আমার কাছে ফোন ছিল না। দুজন ছেলে মোটরসাইকেলে আমাদের রিকশা ফলো করে যাচ্ছিল। আমি তাদের হেল্প চাইলে তারাও ধমক দেয়।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে মিন্নি বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আমি সবাইকে বলব, বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় স্বামীকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা হতে দেখেছি। মানসিকভাবে আমি বিধ্বস্ত। আমার অনুরোধ, আমি তো আপনাদের মেয়ে বা বোন হতে পারতাম। আমি অনুরোধ করব, আপনারা না জেনে কোনো মন্তব্য করবেন না।’ মিন্নি বলেন, ‘আমি চরম মানসিক নিপীড়নে ভুগছি। কেউ আমাদের পাশে নেই। সবাই শুধু সমালোচনায় মুখর। আমি সবার সহযোগিতা চাই।’
এ ব্যাপারে আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর সালমা ইকরাম বলেন, ‘মিন্নির যে অবস্থা তাতে তাকে এখন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নেওয়া উচিত।’
খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিম লীর সদস্য চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়েছে সেটাকে সামনে না এনে কিছু মানুষ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই মিন্নিকে সামনে টেনে আনতে চাইছে। আমাদের সবার উচিত প্রথমে রিফাত শরীফের খুনিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থ্ াকরা। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মিন্নির কোনো অপরাধ যদি তদন্তে বেরিয়ে আসে, যদি করে থাকে তাহলে তারও শাস্তি হবে।’ শুধু শুধু এখন মিন্নিকে দোষ না দিয়ে খুনিদের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সিসিটিভি ফুটেজে মিন্নির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ কিনা- এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘তদন্ত একটি স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেহেতু এটি একটি নারকীয় রোমহর্ষক হত্যাকা এবং মিন্নি এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী। কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে আমরা তদন্ত করছি না। সার্বিক বিষয় নিয়েই তদন্ত প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যতটুকু বিষয় আমাদের সামনে আসছে আমরা সেটুকু নিয়ে কাজ করছি।’
রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে ২ জুলাই ভোররাতে মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত তিনজনসহ ছয়জন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। পরে তাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওইদিন বিকালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত মারা যান।