ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরিচয়েই দাপট দেখান নয়ন ও রিফাত!

বরগুনা কলেজের সামনে রাম দা হাতে যে দুই যুবককে দেখা যায় রিফাতকে এলোপাতাড়ি কোপাতে তারা দুই জন হলেন সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফারাজী। রাজনৈতিকভাবে এরা দুই জনই ক্ষমতাধর।

জানা গেছে, রিফাত ফারাজীর আপন খালু বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। এছাড়া রিফাতের চাচাতো দাদা মরহুম লতিফ ফারাজী ২০ বছর আগে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের ক্যাডার হিসেবেই পরিচিত নয়ন।

এছাড়া বরগুনা পৌরসভার কাউন্সিলর রইসুল ইসলাম রিপনের ছেলে জনির ডান হাত হিসেবেও পরিচিত নয়ন। পাশাপাশি মাদক ব্যবসার বিপুল অর্থ তো আছেই।

বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে নয়ন বন্ডের (২৫) বাসা। নয়নের বাবা মৃত ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে শ্রমিকের কাজ করেন। মাকে নিয়েই ওই বাসায় বসবাস করছিল নয়ন। নয়ন নিজেও ছাত্রলীগের সমর্থক কিন্তু সক্রিয় কর্মী নয়। তার পদও নেই। তবে তার গডফাদার এমপি শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ বলে কথিত রয়েছে।

২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাতে নয়নের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদক, দুইটি দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ নয়নকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বাসা থেকে উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন।

বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবীর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা আমরা জানি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এর আগে নয়ন ও তার সহযোগীরা গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছে কিন্তু বারবারই তারা জামিনে বেরিয়ে যায়।

আরেক খুনি রিফাত ফারাজী বরগুনা সদর উপজেলার রায়েরতবক গ্রামের দুলাল ফারাজীর ছেলে। দুলাল ফারাজী সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মরহুম লতিফ ফারাজীর ভাতিজা।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দুলাল ফারাজীর ভায়রা। স্থানীয়রা জানান, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন রিফাত ফারাজী। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফারাজী। রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

এসব কারণে কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও রহস্যজনক কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পায় সে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করে রিফাত ফারাজী।

উল্লেখ্য, বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে একদল দুর্বৃত্ত হামলা করে রিফাতের ওপর। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল। এর মধ্যেই দা দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয় রিফাতকে। এই ঘটনায় ছড়ানো ভিডিওতে দেখা যায়, মিন্নি অস্ত্রধারীদের হাত টেনে ধরার চেষ্টা করছেন। রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ ঘটনার ভিডিও ধারণ করছেন, ছবি তুলছেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলছেন, কেউ বা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আর হামলাকারীরা মনের আক্রোশ মিটিয়ে চলে গেছে, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি।

এই ঘটনাটি হাইকোর্টের নজরে আনার পর উচ্চ আদালত মর্মাহত হয়েছে। কেউ এগিয়ে আসল না-এটা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দুই বিচারপতি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্বামী হারা তরুণী বলেন, ‘আমি আর আমার স্বামী কলেজে বের হই। হঠাৎ আমাদের উপর আক্রমণ করে। …আমরা কলেজ থেকে বের হবার পর প্রথমে কয়েকজন আমাদের আটকায়। সে সময় ওরা আমার স্বামীকে মারতে শুরু করে। এসময় দা টা কী কী যেন নিয়ে আসে ওরা। পরে সবাই ছেড়ে দেয়। এ সময় রিশাতত নামে একজন ছেলে রিফাতকে ধরে। পরে নয়ন ও রিফাত ফরাজী দুইজন মিলে আমার স্বামীকে কোপাতে থাকে।’ এরপর তাকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে বিকালে রিফাত শরীফ মারা যান।

বাংলাদেশ জার্নাল/