নাজমুল হক নয়ন ২০০৩ সালের ৯ অক্টোবর কনস্টেবল পদের মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করেন ।তারপর ২০১৩ সালে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হয় । তারপর ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে কর্মরত আছে এই নাজমুল হক নয়ন। উপপরিদর্শক (এসআই) পদে পদোন্নতি পেয়েই সে বেপরোয়া হয়ে যায়। মানুষকে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিইয়ে নিয়ে বিশাম সম্পদের বনে যায়।
সেই টাকায় গত তিন বছরে দুটি আলিশান বাড়ি, একটি ইটভাটা, তিনটি প্রাইভেট গাড়িসহ বিপুল ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এক-দুই বছর নয়, টানা ১১ বছর একই জেলায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পদোন্নতির পর আলাদিনের চেরাগ পাওয়া সেই পুলিশ কর্মকর্তা হচ্ছেন গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নাজমুল হক ওরফে নয়ন।
গ্রামের বাড়িতে তিনি ‘ওসি নয়ন’ নামে পরিচিত। এসআই নাজমুল হক নয়নের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।অভিযোগের পাহাড় মাথায় নিয়ে তিনি বর্তমানে গাজীপুরে কর্মরত থাকলেও বেশ কবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলেন।
সর্বশেষ গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার হোতাপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় তিনটি ইউপি নির্বাচনে বিএনপির দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে দামি গাড়ি উপহার নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে তাঁকে পুলিশ লাইনে সম্পৃক্ত করা হয়।দুর্নীতি দমন কমিশনে করা অভিযোগ থেকে জানা যায়, এসআই নাজমুল ময়মনসিংহ শহরে একটি পাঁচতলা বাড়ি, গাজীপুরের শিরিরচালায় একটি চার ইউনিটের তিনতলা বাড়ি, নিজ গ্রামে একটি ইটভাটা, বিস্তর কৃষিজমি, তিনটি প্রাইভেট কার ও বিপুল নগদ অর্থের মালিক।
সব মিলিয়ে তাঁর সম্পদের মূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরের অভিজাত বলাসপুর (তটিনি) আবাসিক এলাকার পাট গুদাম মোড়ের কালিবাড়ী সড়কের বিলাসবহুল ৯৭/৩ পাঁচতলা বাড়িটির মালিক এসআই নাজমুল। ‘নাফিয়া কটেজ’ নামে সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর নির্মিত আধুনিক কারুকার্য ও ফিটিংসে তৈরি বাড়িটির মূল্য অন্তত চার কোটি টাকা।
মেয়ে নাফিয়ার নামে তৈরি বাড়িটির নির্মাণকাজ এক বছর আগে শেষ হয়। ভাড়া দেওয়া বাড়িটির নিরাপত্তায় বাইরে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। ময়মনসিংহের বিলাসবহুল ও আধুনিক বাড়িগুলোর মধ্যে এটি একটি। সৌন্দর্য, আভিজাত্য এবং মূল্য বিবেচনায় স্থানীয়রা বাড়িটির নাম দিয়েছে ‘স্বর্ণকমল’।গাজীপুর সদরের ভবানীপুরের শিরিরচালার প্যানটেক্স কারখানার মোড়ে ‘নাহিন ভিলা’ নামে রয়েছে তাঁর আরেকটি বিলাসবহুল বাড়ি।
হোতাপাড়া ফাঁড়ি থেকে বাড়িটির দূরত্ব তিন কিলোমিটারের কম। ছয়তলা ফাউন্ডেশনের চার ইউনিটের বাড়িটি তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আনুমানিক আড়াই কোটি টাকা মূল্যের এই বাড়িটিও আধুনিক ডিজাইনের। ছেলে নাহিনের নামে তৈরি করা বাড়িটির বাইরে থেকে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা।গাজীপুরে জমি কিনে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে এসআই নাজমুল পুলিশের প্রবিধান লঙ্ঘন করেছেন। পুলিশ প্রবিধানের ১১২(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘পুলিশ অফিসারগণ নিজ জেলা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ইন্সপেক্টর জেনারেলের (আইজিপি) পূর্বানুমতি ছাড়া স্বনামে, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, চাকর-বাকর বা আশ্রিত ব্যক্তির নামে বা বেনামে জমি বা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন না’।
দুই বাড়ি ছাড়াও নিজ গ্রামে একটি ইটভাটার মালিক নাজমুল। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ধলি বাজার গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়ক ঘেঁষে স্থাপন করা ইটভাটাটির নাম ‘স্বপ্না ব্রিকস’। বোনের নামে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে স্থাপিত ইটভাটাটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে চার কোটি টাকার বেশি।নাজমুলের ইটভাটার একজন কর্মচারী জানান, কাগজে-কলমে ছোট ভাই তারা মিয়াকে ইটভাটার মালিক দেখানো হলেও ইটভাটাটির প্রকৃত মালিক এসআই নাজমুল হক। প্রতি সপ্তাহে তিনি ইটভাটায় এসে হিসাবপত্র বুঝে নেন।
আগামী বছর বাড়িসংলগ্ন কাকনি এবং রিয়া ব্রিকসের কাছে আরো দুটি ইটভাটা করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এ জন্য জমি নেওয়া হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই ইটভাটা স্থাপনের কাজ শুরু হবে।তিনটি প্রাইভেট কারেরও মালিক তিনি। একটিতে নিজে চলেন। অপর দুটিতে দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করে।ধলি বাজার গ্রামের বাসিন্দা ওমর আলী, সাইফুল আলম ও রেজাউল ইসলামসহ বেশ কজন কালের কণ্ঠকে জানান, নাজমুলের বাবা কালু মিয়া হাটে গরু কেনাবেচা করতেন। একবার ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হলে তিনি এলাকায় পরিচিতি পান কালু মেম্বার নামে।
তাঁর পাঁচ ছেলের মধ্যে বড় তিনজনই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই)। তিনজনই গাজীপুরে চাকরি করেন। আগে অর্থ-সম্পদ তেমন না থাকলেও এখন কোনো কিছুর অভাব নেই। বড় দুই ছেলে খুব বেশি সম্পদ করতে না পারলেও নাজমুল হক নয়ন গ্রামে বিস্তর কৃষিজমি কিনেছেন। ইটভাটা করেছেন। ময়মনসিংহ শহর ও গাজীপুরে বাড়ি, গাড়ি এবং নগদ টাকা করেছেন। সব মিলিয়ে ১৫-১৬ কোটি টাকার মালিক বলে শুনেছেন তাঁরা।গাজীপুর জেলা পুলিশ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছরের চাকরি জীবনে নাজমুল ১১ বছর ধরেই গাজীপুর জেলায় কর্মরত আছেন। ২০১৩ সালে জয়দেবপুর থানার ভোগড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ থাকার সময় জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। ঈদে শুভেচ্ছা কার্ড ছাপিয়ে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় চাঁদাবাজির অভিযোগে প্রথমে প্রত্যাহার, পরে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে নানাভাবে ম্যানেজ করে স্বপদে ফিরে সর্বশেষ যোগ দেন হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে।
গত ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত স্থানীয় ভাওয়াল গড়, মির্জাপুর ও পিরুজালী এই তিন ইউপি নির্বাচনে বিএনপির দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে দামি গাড়ি উপহার নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে সম্প্রতি তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়। ৩১ মাস হোতাপাড়া ফাঁড়ির দায়িত্বে থাকার সময় শত শত নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নাশকতা, জঙ্গি ও মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এবং চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে এসআই নাজমুল হকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইটভাটার মালিক আমার বাবা। তাঁর টাকায় এগুলো করেছি। আর গাজীপুরের বাড়ি আমি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে করেছি।’ জমি কেনার টাকা পেলেন কোথা থেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি কোথা থেকে টাকা পাইছি সেইটার জবাব কি আপনাকে দিব? পুলিশের যেখানে জবাব দেওয়ার সেখানেই দিছি।’
সুত্রঃ কালের কন্ঠ