খাবারে উল্টা-পাল্টা, বদহজম, এমন নানা কারণে মাঝে মাঝে আমাদের পেটে সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু কিছু কিছু পেট ব্যথা আছে যা আরো ভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যে ব্যথার কারণ আমরা জানি না বা অনেক সময় গুরুত্ব দেই না। এটা জেনে রাখা ভালো যে কিছু উপসর্গ মারাত্মক কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিতে পারে। যদি আপনার নিচে উল্লেখিত পেটব্যথার সম্মুখীন হন, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
তলপেটে ক্র্যাম্পিং (আইবিএস) : যদি পেটব্যথার সঙ্গে পেটফাঁপা, গ্যাস ও মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন (কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া) দেখা দেয়, তাহলে তা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) হতে পারে। ‘গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টরা যেসব গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ডিসঅর্ডার দেখেন তার মধ্যে অন্যতম সর্বাধিক কমন হচ্ছে আইবিএস।’ কারণ অজ্ঞাত হলেও কিছু গবেষণা সাজেস্ট করছে যে, আইবিএসে (কখনো কখনো স্প্যাস্টিক কোলন বলে) ভোগা লোকদের অত্যধিক সেনসিটিভ কোলন বা বড় অন্ত্র থাকে। আইবিএস ওজন হ্রাস বা মলদ্বারীয় রক্তপাতের কারণ হয় না। যদি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কিছু ঘটছে।
পেটব্যথার সঙ্গে মলদ্বারীয় রক্তপাত ও ক্র্যাম্পিং (আইবিডি) : এসব পেটব্যথা প্রায়ক্ষেত্রে ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (আইবিডি) বা প্রদাহমূলক অন্ত্র রোগ নির্দেশ করে। যেখানে ডাইজেস্টিভ ট্র্যাকে দীর্ঘস্থায়ী ফোলা হয়, যাকে ক্রন’স ডিজিজ ও আলসারেটিভ কোলাইটিস বলে। এসব দশার একইরকম উপসর্গ থাকে, যার ফলে একজন রোগী আইবিডির কোন ফর্মে ভুগছেন তা নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে। আইবিডি আইবিএসের চেয়ে অধিক মারাত্মক ও অধিক বিরল।
পেটে জ্বালাময়ী ব্যথা বা বুকজ্বালা : বেশি করে তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পর এ ধরনের অনুভূতি অত্যধিক কমন। এটি হচ্ছে বুকজ্বালা এবং অনেকেই মাসে অন্তত একবার এ ধরনের পেটব্যথায় ভুগেন। ‘এই ব্যথার কিওয়ার্ড হচ্ছে ‘বার্নিং’ বা ‘জ্বালাপোড়া’ এবং এর সঙ্গে সাধারণত আপনার মুখে তিক্ত স্বাদ অনুভূত হবে।’ অ্যাসিড রিফ্লাক্স হচ্ছে আংশিক হজম হওয়া তরল বা খাদ্যের রিগার্জিটেশন, যা পাকস্থলীর অ্যাসিডের সঙ্গে মিশেছে। এই অ্যাসিডিক মিশ্রণ খাদ্যনালী ও গলায় জ্বালাপোড়ার অনুভূতি সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে বুকজ্বালা দুশ্চিন্তার কিছু নয়, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী বুকজ্বালার (যা অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাস্ট্রোএসোফাজিয়েল রিফ্লাক্স ডিজিজ নামে পরিচিত) চিকিৎসা করা না হলে ক্রনিক ডাইজেস্টিভ ডিসঅর্ডারে রূপ নিতে পারে।
নাভির চারপাশে ব্যথা (গলস্টোন) : যদি এই ব্যথার সঙ্গে কাঁধের পাশে নিস্তেজ ব্যথা হয় এবং চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পর অবস্থা আরো খারাপ হয়, তাহলে এর জন্য গলস্টোন বা পিত্তপাথর দায়ী হতে পারে। যদি আপনি নারী হন এবং আপনার বয়স ৪০ এর বেশি হয়, তাহলে আপনি উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। এর কারণ হচ্ছে, ইস্ট্রোজেনের বৃদ্ধি (যা প্রেগন্যান্সির সময় সাধারণ) গলস্টোন সৃষ্টি করতে পারে। ‘পিত্তকোষে সৃষ্টি হওয়া এসব ছোট পাথর অনেক বছর ধরে অনির্ণীত থেকে যেতে পারে এবং সাধারণত সিস্টিক ডাক্টের সঙ্গে আটকে না পড়া পর্যন্ত তারা ব্যথাহীন থাকে।’ গলস্টোনের কারণে আপনার তীব্র পেটব্যথা হতে পারে।
নিস্তেজ ও জ্বালাময়ী পেটব্যথা, যা ভোজনে বা অ্যান্টাসিড গ্রহণে উপশম হয় (আলসার) : এসব হচ্ছে পেপটিক আলসারের লক্ষণ, সঙ্গে পেটফাঁপা, ঢেঁকুর ওঠা, ক্ষুধামন্দা ও ওজন হ্রাসও থাকে। পেপটিক আলসারে পাকস্থলীর স্তর বা ক্ষুদ্রান্তের শীর্ষের ওপর ক্ষত হয়। এর জন্য দুইটি বড় কালপ্রিটের যেকোনো একটি দায়ী হতে পারে। ১. হেলিকোব্যাক্টার পাইলরি (অথবা এইচ. পাইলরি), একটি ব্যাকটেরিয়া যা পাকস্থলীর মিউকাস কোটিংকে ড্যামেজ করে। এবং ২. নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগের (যেমন- অ্যাসপিরিন বা ইবুপ্রোফেন) অত্যধিক ব্যবহার। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে।
তলপেটের বামপাশে হঠাৎ ব্যথা (ডাইভারটিকিউলাইটিস) : যদি এই পেটব্যথার সঙ্গে গ্যাস থাকে, তাহলে এটি ডাইভারটিকিউলাইটিসের ইঙ্গিত দিতে পারে। ডাইভারটিকিউলাইটিস হচ্ছে, বৃহদান্ত্রের ডাইভারটিকুলা নামক ক্ষুদ্র থলির প্রদাহ। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে এটি খুব কমন একটি গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ডিসঅর্ডার। অনেকেরই বয়স ৬০ এর মধ্যে এটি ডেভেলপ হয়ে থাকে। মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ লোকের উপসর্গ দেখা দেয়, যার মধ্যে অত্যধিক পেটফাঁপা, পেটব্যথা, ক্র্যাম্পিং ও কোষ্ঠকাঠিন্য অন্তর্ভুক্ত। ‘এটি আপনার কোলনে গর্ত হওয়ার মতো এবং এটি প্রায়ক্ষেত্রে ডায়েটে ফাইবার ঘাটতির কারণে হয়ে থাকে।’
তলপেটের ডানপাশে তীব্র ব্যথা (অ্যাপেন্ডাইসিটিস) : এই জাতীয় ব্যথা অ্যাপেন্ডাইসিটিস নির্দেশ করতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনার নিম্নমাত্রার জ্বর, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া থাকে। যদি আপনার অ্যাপেন্ডাইসিটিস থাকে, আপনি নড়াচড়া করলে, কাশি দিলে, হাঁচি দিলে, গভীর শ্বাস নিলে এবং তলপেটে চাপ পড়লে আপনার ব্যথা বেড়ে যাবে। অ্যাপেন্ডিক্সে প্রদাহ হলে ও পুঁজ জমলে (প্রায়ক্ষেত্রে ইনফেকশনের কারণে) অ্যাপেন্ডাইসিটিস হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ অনুসারে, অনেকেরই পেটে জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রধান কারণ হচ্ছে, এই যন্ত্রণাদায়ক দশা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে যাওয়ার পূর্বেই অপসারণ করা প্রয়োজন।