চট্টগ্রামের ১৫ বছর বয়সী তাসপিয়ার কথা মনে পড়ে? নগরীর সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া যেই মেয়েটির লাশ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ১৮ নম্বর ব্রিজের উত্তর পাশে পাথরের উপর উপুড় হয়ে পড়ে ছিল লাশটি।
লাশটি পাওয়ার পর তার প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিল সিএমপি পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার। সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল কিশোরীটির ওপর চালানো ভয়াবহ চিত্র। তার পিঠ, বুক ও স্পর্শকাতর অঙ্গসহ সব স্থানেই দেখা গিয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতনের ছাপ। গোলাকার মুখমণ্ডল থেঁতলানো। চোখ দুটোও যেন নষ্ট করে দেয়া হয়েছিলো। আর বুকের ওপর একাধিক আঁচড়ের দাগও দেখা গেছে। নিহতের হাতের নখগুলো ছিল নীলবর্ণ।
এরপর কেটে গেছে অনেকদিন! এ ঘটনায় ছয়জনের নামে থানায় মামলা হলেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাসপিয়ার কথিত প্রেমিক আদনান মির্জাসহ দু’জনকে। আদনানকে কয়েকবার রিমান্ডেও এনেছে। তবে প্রতিবার পুলিশ শুধু একটি কথায় বলেছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
অবশেষে গত বুধবার তাসপিয়ার ময়নাতদন্তকারী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুজন কুমার দাশ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর আজ শুক্রবার (১৩ জুলাই) সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর-পশ্চিম) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘তাসপিয়ার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমরা পর্যালোচনা করেছি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তাসফিয়ার মুখে ও শরীরে বিভিন্ন অংশে আঘাত থাকলেও তার ওপর কোনো ধরণের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। মূলত পানিতে পড়ে শ্বাস বন্ধ হওয়ার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।’
‘এছাড়া সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের প্রতিবেদনেও তাসপিয়ার পোশাক ও যৌনিপথে যৌন সংক্রান্ত ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাসপিয়া পানিতে পড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে। খুন হয়েছে এমন জোরালো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ফরেনসিক ল্যাবের প্রতিবেদন, সুরতহাল প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, গ্রেফতার আসামিদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তদন্ত টিম একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, খুন নয় তাসপিয়া আত্মহত্যাই করেছেন।’
পর্যালোচনার বিবরণে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তাসপিয়া পরিবারের ভয়ে মানসিক চাপ নিতে না পেরে নিজ আগ্রহেই সিএনজি অটোরিকশায় করে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যায়। পরে রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে কোনো এক সময় সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।’
‘এরপরও যেহেতু এটি আলোচিত মামলা, বিষয়টি নিয়ে আরো অধিকতর তদন্ত চালানো হচ্ছে। দুই-একটি প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত টিম। আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে এই মামলার ইতি টানতে পারবো’ বলে জানান তিনি।
তদন্ত সূত্র জানায়, তাসপিয়া স্কুলে পড়ালেখা করা অবস্থায় ফেসবুক-ইমোতে আসক্তি হয়ে পড়ালেখায় মনযোগ হারিয়ে ফেলে। এ কারণে অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন শুরু করে সে। এরই মাঝে বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান মির্জার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাসপিয়া।
বিষয়টি জানতে পেরে তার বাবা নানাভাবে শাসন করতে থাকেন। এরপরও প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য একটি দামি মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ইমো আর হোয়াটসআপ অ্যাপসের মাধ্যমে আদনানের সঙ্গে যোগাযোগ করতো তাসপিয়া।
তাসপিয়া প্রেম ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের জন্য পরিবারের চাপে ছিল। কিন্তু ওই দিন বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে প্রেমিক আদনানের সঙ্গে দেখা করার খবর জানার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই ভয় আর মানসিক চাপ থেকে চায়না গ্রিল থেকে বের হয়ে বাসায় না গিয়ে সোজা সিএনজি অটোরিকশাটি নিয়ে ১৮ মাইল দূরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে চলে যায়। সেখানেই কয়েকঘণ্টা অবস্থান করার পর সে সাগরে জোয়ারের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
আর পানিতে ভাসতে ভাসতে আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে ভাটার সময়ে সৈকতের পাথরের উপর উপুড় হয়ে আটকে থাকে। পানির স্রোতের কারণে পাথরের সঙ্গে তার লাশের ধাক্কা লাগায় মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। আর তাসপিয়ার কোনো টাকা না থাকলেও হাতে থাকা আংটিটি সম্ভবত সিএনজি অটোরিকশার চালককে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে ছিল সে। আর মোবাইলসেটটি এখনো পর্যন্ত যেহেতু সচল হয়নি, ধারণা করা হচ্ছে, পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার সময় সেটিও তার সাথে সাগরে পড়ে গেছে।
পরদিন ৩ মে সকালে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের ১৮ নম্বর ব্রিজঘাটের পাথরের ওপর থেকে তাসপিয়ার লাশ উদ্ধার করে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। প্রথমে অজ্ঞাত লাশ মনে করা হলেও পরিচয় মেলার পর একই দিন সন্ধ্যায় খুলশি থানার জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাসা থেকে তাসপিয়ার বন্ধু আদনানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় পুলিশ।
আদনান মির্জা নগরের বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। তাসপিয়াকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে তার বাবা মো. আমীন সেদিন দুপুরে তাকে প্রধান আসামি করে ছয় জনের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন।
আসামিরা হলেন- আদনান মির্জা, সৈকত মিরাজ, আশিক মিজান, ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম, মো. মোহাইন ও মো. ফিরোজ। এর মধ্যে ঘটনার পরদিন তাসফিয়ার বন্ধু আদনান মির্জা এবং গত ২৩ মে রাতে আশিক মিজানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত ৩ জুলাই আত্মসমর্পণ করলে তাসপিয়া হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি কথিত যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। গত ৮ জুলাই ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।