কিডনি রোগ নিয়ে – সন্দেহ নেই কিডনি শরীরের অন্যতম একটি অঙ্গ। কিডনি শরীরের অনেক কাজ করে। তবে মূল যে কাজগুলো করে তা হলো গোটা শরীরের পি-এইচ। অর্থাৎ অম্ল ও ক্ষারের মাত্রার একটা ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বের করে দেয়। কিছু হরমোন যা হাড় বৃদ্ধি (ভিটামিন-ডি), মজ্জা থেকে রক্ত তৈরি (ইরাইথ্রোপয়েটিন), রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ (রেনিন) উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। কিডনি রোগ অনেক ধরনের হতে পারে। কিন্তু এই কিডনি রোগের চিকিৎসা নিয়ে অনেকেরই কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। স্বল্প পরিসরে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
০১. ভুল ধারণা: কিডনি রোগ বংশগত। সঠিক ধারণা: পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজের মতো অল্প কিছু কিডনি রোগ রয়েছে যা বংশগত কারণে হয়ে থাকে বলে জানা যায়। অধিকাংশ কিডনি রোগই বংশগত নয়।
০২. ভুল ধারণা: কিডনি বিকল মানে একটি বা দুটি কিডনি বিকল। সঠিক ধারণা: কিডনি রোগে একটি কিডনি আক্রান্ত হওযার ঘটনা খুবই কম। বিশেষ করে কিডনি বিকল বলতে দুটি কিডনিই বিকল বোঝায়। কারণ যখন একটি কিডনি বিকল হয় তখন শরীরের তেমন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও কোনো তারতম্য ধরা পড়ে না। শরীরে যখন কিডনি রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে তখন দু’টি কিডনিই আক্রান্ত হয়েছে বলে বুঝতে হবে। বিশেষ করে কিডনি বিকলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সত্য।
০৩. ভুল ধারণা: ডায়ালাইসিস একবার শুরু করলে তা স্থায়ীভাবে করতে হবে। সঠিক ধারণা: ডায়ালাইসিস হচ্ছে রক্ত পরিশোধনের একটি আধুনিকতম প্রক্রিয়া। কিডনি অতিমাত্রায় বিকল হলে এটি করতে হয়। যখন ডায়ালাইসি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন রোগীর চিকিৎসার জন্য কিডনি সংস্থাপন ছাড়া অন্য কোনো উপায় আর হাতে থাকে না। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচানোর জন্য ডায়ালাইসিস করা হয়। কাজেই ডায়ালাইসিস করা শুরু করলে পরবর্তীতে সেটি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর তখন ডায়ালাইসিস না করা মানে অকালে মৃত্যুর প্রহর গোনা। কাজেই এখানে ডায়ালাইসিস শুরু করার মধ্যে কোনো ভুল নেই। তবে হঠাৎ কিডনি বিকল হলে তখন যদি কারো ডায়ালাইসিস লাগে সেটি হবে সাময়িক। কিডনি সঠিকভাবে কাজ শুরু করার পর আর তা করার দরকার পড়ে না।
০৪. ভুল ধারণা: কিডনি দান করা নিরাপদ নয়। সঠিক ধারণা: ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত নয় এমন ব্যক্তি যদি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন তাহলে তার জন্য কিডনি দান কোনো ঝুঁকির বিষয় নয়।
০৫. ভুল ধারণা: বেশি পানি খেলে কিডনি রোগী ভালো থাকে। সঠিক ধারণা: কিডনির জন্য কখনোই অতিরিক্ত পানি ভালো নয়। পর্যাপ্ত পানি গ্রহণই হচ্ছে সঠিক কাজ। শুধুমাত্র কিডনিতে খুবই ছোট কোন পাথর থাকলে তখন সেটিকে পানি প্রবাহের তোড়ে বের করে আনার জন্য একটু বাড়তি পানিপান করতে বলা হয়। কিন্তু কিডনি রোগ হলে বরং পানিপানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে তখন কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে পানি পান করাই শ্রেয়।
০৬. ভুল ধারণা: বিয়ার খাওয়া কিডনির জন্য ভালো। সঠিক ধারণা: বিয়ার খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে কিন্তু তাতে বিকল কিডনির কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে এই পদ্ধতি কোনো কাজে আসবে না। আর বিয়ার খেয়ে প্রস্রাব বাড়ানোর মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতাকে বাড়ানো সম্ভব নয়।
০৭. ভুল ধারণা: কিডনিতে পাথর হওয়ার বিষয়টি বিরল ঘটনা। সঠিক ধারণা: কিডনিতে পাথর কোনো বিরল ঘটনা নয়। এটি কিডনির সবচেয়ে সচরাচর ঘটনা। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ এন্ড কিডনি ডিজিজেসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রায় ১০ ভাগ আমেরিকান তাদের জীবনের কোনো না সময়ে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যাদের বয়স ২০-৪০ বছরের মধ্যে।
০৮. ভুল ধারণা: কিডনি পাথরের সঙ্গে কিছু খাবারের সম্পর্ক রয়েছে। সঠিক ধারণা: সব সময়ে এটি হয় না। যাদের কিডনি পাথর হওযার প্রবণতা রয়েছে তাদের বেলায় এটি কিছুটা প্রযোজ্য। তবে সুস্থ স্বাভাবিক লোকের বেলায় নয়। এ বিষয়ে আমেরিকার একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, যারা অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ করেন তাদের কিডনি পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। কারণ বাড়তি আমিষের কারণে শরীর থেকে বাড়তি ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। ফলে প্রস্রাবে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি ঘটে। যা কিডনি পাথর তৈরিতে সহায়ক। আবার অনেকের ধারণা যেহেতু বেশিরভাগ কিডনি পাথরই ক্যালসিয়ামের তৈরি তাই ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার কম খেলে কিডনি পাথর হবে না। সাম্প্রতিক গবেষণায় এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম ক্যালসিয়াম শরীরে অন্যান্য বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই স্বাভাবিক মাত্রার ক্যালসিয়াম খেতে হবে। কম ক্যালসিয়াম খাওয়ার চেয়ে স্বাভাবিক মাত্রার ক্যালসিয়াম গ্রহণই ভালো। তবে যাদের ইতিমধ্যে কিডনি পাথর আছে তারা কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ কখনোই কিডনি পাথর হওয়ার প্রবণতা কমায় না।
০৯. ভুল ধারণা: কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট মানে কিডনি প্রতিস্থাপন। সঠিক ধারণা: অনেকেরই ধরণা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট মানে আক্রান্ত কিডনিকে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন একটি কিডনি জুড়ে দেয়া বা প্রতিস্থাপন করা। আসলে বিষয়টি তা নয়। কিডনি বিকল হওয়ার রোগীকে যখন কিডনি সংস্থাপনের সময় বিকল কিডনিকে আগের স্থানেই রেখে দেয়া হয়। বিকল কিডনি দুটির সঙ্গে নতুন সুস্থ একটি কিডনিকে জুড়ে দেয়ার বিষয়টিই হচ্ছে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা কিডনি সংস্থাপন বা সংযোজন। বিকল কিডনিকে ফেলে দেয়ার ঘটনা খুবই বিরল।
১০. ভুল ধারণা: কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলেই কিডনি নিয়ে আর কোনো দায়িত্ব নেই। সঠিক ধারণা: অনেকেরই ধারণা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর রোগীর সুস্থ জীবনযাপনে আর কোনো বাধা নেই। আসলে এ ধারণা একদম ঠিক নয়। কারণ কিডনি সংস্থাপনের পর কিডনিটি যাতে শরীরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে অর্থাৎ কিডনিটি যাতে শরীর থেকে বিয়োজিত হয়ে না যায় সেজন্য রোগীকে সারাজীবন বিশেষ কিছু ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। এই ওষুধ গ্রহণ করা অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে থাকে। এছাড়া রোগীর যাতে সহসা কোনো ইনফেকশন না হয় সেজন্য রোগজীবাণু থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো না বুঝলে সংযোজিত কিডনিকে শরীর ত্যাগ করতে পারে।
লেখক: ডা. সজল আশফাক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্য নিবন্ধকার।