ঈদুল ফিতর সমাগত। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ হলো আনন্দের দিন। আর এই আনন্দের অন্যতম আকর্ষণ হলো নাড়ির টানে পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে গ্রামের বাড়ির পথে ছুটে চলা। যাত্রাপথে, বিশেষ করে যারা দূরদূরান্তে যান, তাদের রাস্তাঘাটে পোহাতে হয় হাজারো দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনা। তারপরও বাসায় ফেরার আনন্দে মন থাকে মাতোয়ারা। তাই কষ্টগুলো আর বড় হয়ে ওঠে না। এই সময়টাতে অনেককেই ভ্রমণ করতে হয় বাস, ট্রেন, লঞ্চ অথবা বিমানে। রাস্তায় যানজট, ফেরি স্বল্পতা ও পারাপারের সংকট, লঞ্চ-স্টিমারে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি। প্রচণ্ড ভিড় আর ঠেলাঠেলি করে ক্লান্তিকর ও দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে বাড়ি পৌঁছতে হয়, আবার ছুটি শেষে কাজে যোগদান করতে হয়। সবাই চায় নির্বিঘ্নে আর নিরাপদে ঘরে ফিরতে। তবে যাওয়া আসার ঝক্কিতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিশু ও বয়স্কদের পক্ষে লম্বা যাত্রাপথের ধকল সহ্য করা খুব কঠিন হয় বৈকি। যাত্রাপথে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যথায় পুরো ঈদের আনন্দ আগভাগেই মাটি হয়ে যেতে পারে। তাই ঈদ ভ্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়াটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। যাত্রা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যাগের মধ্যে কম জিনিসপত্র নেওয়া ভালো, যা সহজে বহন করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিতে যেন ভুল না হয়। কিছু প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যকীয় টিপস দেওয়া হলো:
পরিধেয় পোশাক : ভ্রমণের সময় হালকা, আরামদায়ক ও সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন পোশাক পরা উচিত। টাইট কাপড়-চোপড় পরিহার করাই ভালো। এতে ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরামদায়ক। নরম জুতা বা স্যান্ডেল পরা উচিত। আবার একেবারে নতুন জুতা পরে কোথাও রওনা হবেন না। মেয়েদের জন্য হাইহিল পরিহার করে ফ্লেট স্যান্ডেল পরা উচিত।
খাবার ও পানির ব্যাপারে সতর্কতা : বাইরের খাবার কোনোভাবেই গ্রহণ করা ঠিক হবে না। ঘরের তৈরি খাবার ও পানির বোতল সঙ্গে নেওয়া উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী নিজে পানি পান করুন এবং বাচ্চাদেরও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাবেন। ভ্রমণে খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি।
প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ফার্স্ট এইড বক্স : ঈদের সময় জরুরি ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ ফার্স্ট এইড বক্স নেওয়া উচিত। কারণ গ্রাম এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। জ্বর, মাথা বা শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, পেটের পীড়ার জন্য মেট্রোনিডাজল, পেটে গ্যাস, পেটফাঁপা, বুক জ্বলার জন্য এন্টাসিড, রেনিটিডিন বা ওমেপ্রাজল, সাধারণ সর্দি কাশির জন্য এন্টি-হিস্টামিন, ডায়রিয়ার জন্য ওরাল স্যালাইন ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। এছাড়াও তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, স্যাভলন ইত্যাদি সংগ্রহে রাখুন। হাত কেটে গেলে কিংবা শিশুরা খেলতে গিয়ে শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে এগুলো সহায়ক হবে। নোটবুকে আপনার পরিচিত চিকিৎসক ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখলে ভালো হয়। যারা বিভিন্ন রোগে ভোগেন, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, তারা অবশ্যই ঈদ ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিতে ভুলবেন না।
মোশন সিকনেস : কারও কারও বাসে বা যানবাহনে উঠলে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব এমনকি বমি হয়, যাকে বলে ভ্রমণজনিত মোশন সিকনেস। এ সমস্যা প্রতিরোধে স্টিমেটিল বা ভার্গন ট্যাবলেট ভ্রমণের আধা ঘণ্টা আগে খেয়ে নেবেন। এছাড়াও বাস বা ট্রেন চলাকালে বাইরের দিকে তাকিয়ে না থেকে চোখ বন্ধ রাখুন, ঘুমিয়েও নিতে পারেন। যাত্রাপথে অনেকে বই পড়ে সময় কাটান। এই অভ্যাসটা ভালো, কিন্তু যারা মোশন সিকনেসে ভোগেন, তারা ভ্রমণের সময় বই পড়া পরিহার করুন। কারণ যান-বাহনের দুলনির সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ার ফলে মাথা ঘোরা শুরু হতে পারে, বমিও হতে পারে।
শিশুদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা : ট্রেনে, বাসে কিংবা লঞ্চে ভ্রমণের সময়ে শিশুরা সব সময়েই জানালার ধারের সিটটি পছন্দ করে। এ কারণে হঠাৎ করে অতিরিক্ত বাতাসের মুখোমুখি হয়। ফলে শিশুরা অনেকে ঠিক ভ্রমণের পর পরই আক্রান্ত হয় সর্দি-জ্বর কিংবা সাধারণ কাশিতে। এছাড়াও বাইরের পানীয় এবং খাবার খেয়ে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাই তারা যাতে যাত্রাপথে বাইরের খাবার না খায়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকুন। একেবারে ছোট দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে ভ্রমণ না করাই উচিত। তবে একান্ত প্রয়োজনে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। চলার পথে শিশুকে অবশ্যই ধরে রাখবেন, ট্রেন, বাস বা লঞ্চ থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
বয়স্কদের জন্যও সতর্কতা : দীর্ঘ ভ্রমণ বয়স্কদের জন্য বেশি কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন রোগসহ অনেকেই বাতজ্বর বা আর্থ্রাইটিসে ভোগেন। তাদের জন্য বাসে বা ট্রেনে ওঠাও সহজ নয়। ওঠার সময় তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। যাত্রাপথে যেন তারা একই ভঙ্গিতে বেশিক্ষণ বসে না থাকে এবং মাঝেমধ্যে যানবাহনের মধ্যেই যেন কিছুক্ষণ চলাফেরা করে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। তা না হলে বাতের ব্যথা বাড়তে পারে, এমনকি পায়ে পানি জমে পা ফুলেও যেতে পারে।
পথে পানাহার এবং অজ্ঞান পার্টি থেকে সাবধান : যাত্রাপথে যানবাহনে অপরিচিত কেউ খাদ্য বা পানীয় দিলে খাবেন না। কারণ প্রায়ই শোনা যায়, এ ধরনের খাবার খেয়ে অনেকেই বড় দুর্ঘটনায় পড়েছেন। এই বিপদ এড়াতে সচেতন থাকবেন। রাস্তাঘাটের দোকান থেকে খাবার এবং পানীয় পরিহার করুন। এগুলো খেয়ে ডায়রিয়া বা আমাশয়ে আক্রান্ত হলে উৎসবের আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতে পারে। বাসা থেকে পানি ও খাবার নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় ভ্রমণে করণীয় : অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা অতিরিক্ত ঝাঁকি হয়, এমন পথে ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রথম তিন মাস ও সম্ভাব্য ডেলিভারির ২-৩ মাস আগে ভ্রমণ এড়িয়ে চলাই ভালো। গর্ভাবস্থায় কোনোক্রমেই একা ভ্রমণ না করা উচিত। নিরাপদ মাতৃত্বের স্বার্থে কোনো ধরনের বিপদের ঝুঁকি নেবেন না।
রোজা অবস্থায় ভ্রমণ : রোজা রেখে রওনা হলে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে খাবার এবং পানীয় সঙ্গে রাখুন, যেন ইফতারের সময় বাইরের খাবার খেতে না হয়। একটু সতর্ক হলেই প্রতিরোধযোগ্য অসুখ-বিসুখ সহজে এড়ানো সম্ভব। ঈদ অবশ্যই খুশি আর আনন্দের, যাত্রা নিরাপদ হলেই প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ হয়ে উঠবে আরও আনন্দময়। তাই এসব বিষয়ে আমাদের একটু সচেতন হতে হবে।
লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।