জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে অন্তত একবার মাদক গ্রহণ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ কোটি। এদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ মাদকসংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত। মাদক মানুষ ও একটি পরিবার কে ধ্বংস করে দেয়। মাদকের বিস্তার কমানোর জন্য দেশে দেশে যুগে যুগে রাষ্ট্রপ্রধানরা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবার সেই মাদকের ভয়ঙ্কর সব কথা নিয়ে লিখেছেন- জিয়া উল ইসলাম
উপমহাদেশে মাদকের ইতিকথাঃ মাদক দ্রব্য হলো একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদক দ্রব্যে বেদনানাশক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক, আচ্ছন্নতা রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদক দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত। মাদকের ব্যবহার আদিকাল থেকেই ছিল। কিন্তু সেটি আধুনিকালের মাদকের নয়। আদিকালের মানুষেরা প্রাকৃতিক উদ্ভিদ থেকে কিছু নেশাদ্রব্য তৈরি করে ব্যবহারকরতো। কিন্তু এ ধরনের মাদকের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সীমিত আকারে। যারা তৈরি করতে পারতো বা মাদকের ব্যবহার সম্পর্কে জানতো এ ধরনের মাদক শুধু তারই ব্যবহার করতো। কিন্তু ঐ মাদক বাজারজাত করা হতো না। হিন্দুধর্মের পৌরানিক কাহিনীতেও মাদক ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে সেটি শুধু নেশার জন্য নয়। অতীতে ধর্মীয় নানা আচার অনুষ্ঠান, পুজাপার্বন, বিয়ের অনুষ্ঠান এবং আনন্দ অনুষ্ঠাগুলোতের নেশা দ্রব্যের ব্যবহার ছিল সীমিত আকারে। হিন্দু ধর্মের বর্ণবৈশম্যেও পাশাপাশি মানুষের মধ্যে শ্রেনি বিভাযনে মাদক ব্যবহারের ধরণও পাল্টাতে থাকে। প্রাকৃতিক উদ্ভিদ থেকে ‘আফিং’(পপি ফুলের বীজ থেকে তৈরি), ‘গাজা’, ‘ভাং’, ধুতরাপাতা থেকে তৈরী নেশা দ্রব্য,ভাত পঁচিয়ে তৈরি ‘চুয়ানি’,তালের রসের ‘তারী’ মানুষ নেষা হিসেবে ব্যবহার করতো। শ্রেনিভেদ অনুযায়ী মানুষ এ ধরনের নেশাদ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এর সাথে ছিল তামাক পাতার ব্যবহার ‘তামাক’ এর মাধ্যমে ধুমপান। এই তামাক পাতার ব্যবহারে ধূমপানটি করা হতো হুক্কার (নাড়কেলের খুলি ও কাটের ছিদ্রযুক্ত লম্বা লইচার তৈরী) মাধ্যমেসেটি করা হতো। তবে এ ধরনের নেশাকে বেশীরভাগ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখতো। ইসলাম ধর্মে মাদকে হারাম হিসেবে ঘোষণা করায় মুসলমান ধর্মে বিশ্বসীরা নেশাকে ঘৃনার চেখে দেখে। এ উপমহাদেশে মুসলীম শাষনের শেষাবধি সময় পর্যন্ত মাদক ব্যবহারের বিস্তার তেমন একটা ঘটেনি। মুসলী শাসন পর্যন্ত ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যদিয়েই মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত ছিল। এর জন্য ভিন্ন কোন আইন প্রণীত ছিল না। পাকভারত উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহন করে ব্রিটিশরা। এই ইংরেজ শাসকদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার সংগে ছিল মদ। মদ খাওয়াটা তাদের জন্মগত ও পারিবারিক বৈশিষ্ট ছিল। ঐ দেশের আবহাওয়ার সাথে তামিলিয়ে এ ধরনের পরিমিত অ্যালকোহল (মাদক) পান তারা করতো শারীরিক প্রয়োজনে। সেটি কখনও মাত্রারিক্ত ছিল না। এদেশে এসেও তাদের জীবন-যাপনে এর ধারাবাকিতা বজায় রেখেছিল।ইংরেজদের সাথে মেলা মেশায় ধনীক,বনিক, আমলা, মুৎসুদ্দি ভূস্বামী, জমিদার শ্রেনির উদ্ভোব হয়। তারা ইংরেজদের সাথে মেলামেশায়, আথিতেয়তার অনুষ্ঠানে, ক্লাবে গিয়ে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। অভ্যস্ত হয় মদ্যপানে।
ইংরেজরাও দেশের মানুষের চরিত্র হননে, উঠতি ধনীক শ্রেনির মাঝে মাদক ও নারীশুক্তির এক সংস্কৃতি তৈরি করে। এ ধরনের মাদকাশক্তদের জন্য ইংরেজদেও ব্যপক পরিমাণ মদ ইংল্যান্ড থেকে আমদানী করতে হতো। তাদের শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘকালীণ সময় টিকেয়ে রাখার কৌশল হিসেবে এ ধরণের সংস্কৃতি ফলপ্রসু হওয়ায়। তারা এর পরিধির ব্যবকতা সৃষ্টির জন্য সে সময়ে উপমহাদেশের প্রতিষ্টিত বিভিন্ন শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় মাদকের অবাধ ব্যবসা। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করা হয় পতিতালয়। পতিতালয়ে পাশাপাশি বিভিন্ন শহর বন্দর এলাকায় স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে এ্যালকোহল তৈরির জন্য গড়ে তোলা হয় কারখানা। পাশাপাশি বৃটিশ আইন করে এর উৎপাদন, বাজারজাত করণ ও বিক্রি ব্যবস্থার প্রচলন করে। এর জন্য আইনের মাধ্যমে এজন্টে, ডিলার ও বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ঐ সময় থেকে বৃটিশ তৈরি থানা এলাকাগুলো পর্যন্ত আফিং, ভাং, গাজা, মদ (স্থানীয় ভাবে তৈরি এ্যালকোহল), বিক্রির এই সংস্কৃতির পাকাপোক্ত রূপদানের জন্য বৃটিশ এর জন্য তৈরি করে আইন। যে আইনের কাঠামোয় থানায় লাইসেন্স প্রদান করা হয়।
মাদক দেহে ও মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ করেঃ নিওরো কেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে ,মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গায় অতি দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়,যা একজন ব্যক্তিকে মাদকের আনন্দ দেয়। এবং পরবর্তী কালে ব্যবহারে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকে আসক্ত তাদের বেলায় আবার উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন মাদক নেয়ার ফলে যে ডোপামিন একজন মানুষকে নেশার আনন্দ দিত তা আস্তে আস্তে কার্যকারিতা হারিযে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা নিচ্ছে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং এটা থেকে একসময় বের হয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে মাদক মানুষকে এমন একটি আনন্দ দেয় যার কাছে মজাদার জিনিসগুলো যেমন খাদ্য , পানীয় এবং যোন মিলনের আনন্দের মত আনন্দের জিনিসগুলো স্লান হয়ে পড়ে। কারণ এই ছোট ছোট আনন্দগুলো মানুষ একই নিওরোট্রান্সমিটার অর্থাৎ ডোপামিন-এর মাধ্যমে পেয়ে থাকে। মাদকের আনন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে এই আনন্দগুলো কার্যকারিতা হারিযে ফেলে এবং মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা চেতনা।দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহারকারীদের ডোপামিন এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের যে সমস্ত জায়গা ডোপামিন এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে সেই জায়গাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মাদক গ্রহণের পরিমাণের ভিন্নতার কারণে দেহে ও মস্তিষ্কে এর প্রভাব ভিন্ন হয়। খুব অল্প পরিমাণে মাদক উদ্দীপক বস্তু হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে মাদক গ্রহণ করা হলে তা যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যার পরিণতি হয় মৃত্যু।
বাংলাদেশে মাদকের অনুপ্রবেশঃ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ মাদকদ্রব্যের সঙ্গে কম বেশি পরিচিত থাকলেও এদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যায় স্বাধীনতা উত্তর সময়ে। অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান তিনটি আফিম ও আফিমজাত পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের কাছাকাছি একটি দেশ। ১৯১৭ সালে সমবায় ভিত্তিতে নওগাঁ জেলায় সর্বপ্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। স্বাধীনতাপূর্ব কাল হতে বাংলাদেশে ছিল সীমিতসংখ্যক লাইসেন্সধারী আফিমসেবী। কিন্তু স্বাধীনতার পর গাঁজা ও মদের প্রচলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৩-৮৪ সালের আগে এ দেশের কেউ হেরোইন চিনত না। অথচ ব্যাপকভাবে হেরোইন চোরাচালান বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে তার বাজারজাতকরণের ফলে ৮৫-৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত হেরোইনসেবীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯৮৭-৯১ সাল পর্যন্ত বিশেষত তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়। নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। তবে ২০০৫ সাল থেকে জেলা ও থানা পর্যায়ের তরুণ-তরুণীর হাতে ইয়াবা ট্যাবলট চলে যায়। এর আগে ২০০০ সাল থেকে সীমান্ত পথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে।
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেশে দেশেঃ কলম্বিয়াঃ কোকেন উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশ কলম্বিয়া। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দেশটিতে মাদক সংশ্লিষ্ট হত্যাকান্ডের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়েছে। শুধু নিহতের সংখ্যা দিয়ে দেশটির মাদকযুদ্ধের ব্যাপ্তি অনুধাবন করা যায় না। ১৯৮০-র দশক থেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তচ্যুত হয়েছে আড়াই থেকে চার মিলিয়ন মানুষ। নিরাপত্তার জন্য এসব মানুষ নিজেদের বাড়িঘর রেখে ছুটেছেন অন্যত্র। একই সময়ে কয়েক হাজার হেক্টর বন কেটে ফেলা হয়েছে। এসব বনে কোকা উৎপাদন ও কোকেন তৈরির কারখানা ছিল। প্রতি হেক্টর কোকা ক্ষেতের জন্য তিন হেক্টর বন ধ্বংস করা হয়েছে। দেশটির মাদক সম্রাটদের হাতে ৫ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি রয়েছে। যার কারণে কোকেন উৎপাদন কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্র : ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক ভাষণের মধ্য দিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। দুই বছরের মাথায় নিক্সন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নতুন লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন। রিগ্যানের ঘোষণার পরই মাদকবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ ও লোকবল নিয়োগ বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবছর ৫১ বিলিয়ন ডলার। ১৯৮০ থেকে সালে গ্রেফতারকৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ লাখের বেশি। ১৯৮৪ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে শুধু না বলুন প্রচারণায় রূপ দেন নিক্সনের স্ত্রী ন্যান্সি। মাদকের সরবরাহ বন্ধ করতে মেক্সিকো, কলম্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অভিযান চালায় ও সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রশাসন ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার না করার ইঙ্গিত দেয়। সর্বশেষ গত বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন পুনরায় মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
মেক্সিকো : ১৯৬০ সালে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করা মাদক মেক্সিকোতে। ২০০৬ সালে দেশটিতে মাদকবিরোধী যুদ্ধে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত মেক্সিকো। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফেলিপ চালডেরন ২০০৬ সালের শেষ দিকে সাড়ে ছয় হাজার সেনা সদস্যকে মিচোয়াচান রাজ্যে মোতায়েন করেন। সরকারি তথ্য অনুসারে, ওই বছর ১১ হাজার ৮০৬টি হত্যাকান্ড ঘটে, ২০১৬ সালে গুমের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৩৪০টি। অপরাধীচক্র, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালে গুমের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। মেক্সিকোর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের জীবিত বা মৃত খুঁজে পাওয়ার ছিল তখন মাত্র ২৫ শতাংশ।
ব্রাজিল : মাদকের করালগ্রাস থেকে রেহাই পায়নি ব্রাজিলও। ব্রাজিলে ১৯৭০-এর দশকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৪ সালে দেশটিতে প্রায় ৬০ হাজার হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কতটি হত্যাকা- মাদকসংশ্লিষ্ট তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে রিও ডি জেনিরো শহরের ৪৮০টি হত্যাকান্ডের মধ্যে ৪০০টিই ছিল মাদক সংশ্লিষ্ট।মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ব্রাজিলে মাদকবিরোধী যুদ্ধের পুলিশের অভিযান মানেই মৃত্যু। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালেই ব্রাজিল পুলিশ ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। যদিও পুলিশ বরাবরই দাবি করে এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে অপরাধী চক্রের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জের ধরে।
ফিলিপাইন : নিহতের গলায় কার্ডবোর্ডে লেখা থাকে, ‘আমি একজন মাতাল। আমাকে পছন্দ করবেন না। সন্দেহভাজন মাদকসেবী ও বিক্রেতার লাশ অন্ধকারে, ব্রিজের নিচে ও ময়লার স্তুপে পড়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়াতে প্রায় দুই বছর আগে ফিলিপাইনের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। তার এই যুদ্ধ ছিল অবৈধ মাদকের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধের নিহতের সঠিক সংখ্যা এমনকি পুলিশও জানে না। অনেক সময়’ লাশের সংখ্যা বাড়ছে কালুকান, মালাবন, নাভোটাস ও ভালেনজুয়েলা জেলায়। রাজধানী ম্যানিলা থেকে দূরে ঘনবসতিপূর্ণ এসব জেলা আবাসিক ও শিল্প এলাকা হলেও হত্যাক্ষেত্র হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। ফিলিপাইনে মাদকবিরোধী যুদ্ধে এ পর্যন্ত কতজন নিহত হয়েছেন তা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনও তথ্য নেই। মানবাধিকার সংগঠন ও নিহতের পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। মানবাধিকার গোষ্ঠী, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের নিহতের সংখ্যা নিয়ে পৃথক পরিসংখ্যান রয়েছে। সরকার নিজেই জানিয়েছে, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে মাদক সংশ্লিষ্ট হত্যাকান্ডের সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৩৫৫টি হত্যাকান্ডের তদন্ত চলছে এবং ৩ হাজার ৯৬৭টি হত্যাকান্ড ঘটেছে পুলিশি অভিযানে।
বাংলাদেশ : চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী অভিযান। এ বছরের ১৪ মে র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখানোর জন্য র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দেন। বাংলাদেশে এ ঘোষণার পর র্যাব ও পুলিশের অভিযানের সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অনেক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। আইন শৃখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি এরা সবাই মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত এবং পুলিশ বা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার কারণে পাল্টা হামলায় নিহত হয়েছে।
থাইল্যান্ড : তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা মাদক বা ইয়াবা বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী ২০০৩ সালে ইয়াবা পাচার ও ব্যবহার বন্ধের উদ্দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম তিন মাসেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয় ২ হাজার ৮০০-এর বেশি মানুষ। ইয়াবাকে থাইল্যান্ডে বলা হয় ‘ক্রেজি ড্রাগস’। ৩ লাখ ২০ হাজার মাদকসেবী চিকিৎসার জন্য আত্মসমর্পণ করেন। সরকারি কর্মকর্তাদের করা ‘কালো তালিকা’ অনুযায়ী গ্রেফতার ও হত্যাকান্ড চালানো হতো।
আফগানিস্তান : ড্রোন দিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয় আফগানিস্তানে। দক্ষিণ আফগানিস্তানের বিমান ঘাঁটিগুলোতে স্কোয়াড্রন এ-১০সি ওয়ারথগ থান্ডাররোল্ট জঙ্গি বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। মার্কিন ও আফগান বাহিনীর যৌথ অভিযানের অংশ হিসেবে এগুলো দিয়ে তালেবানদের মাদক কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
বেশি নেশা সৃষ্টিকারী ৫টি ভয়ঙ্কর মাদকঃ
হেরোইন : এ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নেশা উদ্রেককারী মাদক হিসাবে নাট হেরোইনের কথা তুলে ধরেছেন। মাদকতার মাত্রা বোঝাতে ৩ পয়েন্টের একটি স্কেলে হেরোইন ২.৫ পয়েন্ট পায়। মস্তিষ্কে ডোপামাইনের ক্ষরণ মাত্রা বৃদ্ধি করে। তৃপ্তিকর অনুভূতি ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি করে দেয় হেরোইন। পরিমাণের বেশি হেরোইন মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ ছাড়া ব্যবহারকারী ও সমাজের ক্ষতি করে এমন ধ্বংসাত্মক মাদকের মধ্যে হেরোইন আছে দ্বিতীয় পর্যায়ে।
অ্যালকোহল : আমেরিকা ও ব্রিটেনে অ্যালকোহল বৈধ। কিন্তু নেশা সৃষ্টির দিক থেকে একে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন বিশেষজ্ঞ, যা স্কেলে ২.২ পয়েন্ট পেয়েছে। মস্তিষ্কে নানা ধরনের প্রভাব ফেলে অ্যালকোহল। ডোমামেইন বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্কে তৃপ্তিকর অনুভূতি ৪০-৩৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। জীবনের কোনো এক সময় থেকে অ্যালকোহলের ওপর নির্ভর করেন এমন অসংখ্য মানুষ আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক গবেষণায় জানায়, ২০০২ সাল থেকে অ্যালকোহল পান করেন এমন ৩০ লাখ মানুষ ২০১২ সালে মারা যান। ক্ষতির দিক থেকে একে প্রথম স্থানে রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোকেইন : সরাসরি মস্তিষ্কে গিয়ে কাজ করে। নিউরন থেকে নিউরনে যে তথ্য আদান-প্রদান হয় ডোপামেইনের মাধ্যমে তাতে মিশে যায় কোকেইন। মস্তিষ্কের তৃপ্তিকর অনুভূতি সৃষ্টিতে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ডোপামেইনের পরিমাণ তিন গুন বৃদ্ধি পায় কোকেইনের কারণে। ক্ষতির মাত্রায় একে তৃতীয় অবস্থানে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। যারা কোকেইন গ্রহণ করেন তাদের ২১ শতাংশ এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
বার্বিচুরেটস : এর নানা নাম প্রচলিত। একে বলু বুলেটস, গরিলাস, নেম্বিস, বার্বস এবং পিঙ্ক লেডিস নামে ডাকা হয়। আপাতদৃষ্টিতে দুশ্চিন্তা মুক্তি এবং ঘুমের জন্যে একে ব্যবহার করা হয়। মস্তিষ্কের রাসায়নিক সিগনালের সঙ্গে কাজ করে এটি। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। কম ডোজে উৎফুল্যতা অনুভূত হয়। কিন্তু বেশি ডোজ নীরব ঘাতক হতে পারে। এটি একটি ওষুধ, তাই সহজলভ্য। তবে একে মাদক হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে নেই। ক্ষতির মাত্রা খুব বেশি নয়। কিন্তু নেশার মাত্রার দিক থেকে একে চতুর্থ অবস্থানে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
নিকোটিন : তামাকের প্রতি নেশার প্রধান উপাদান নিকোটিন। কেউ ধূমপান করামাত্রাই ফুসফুস নিকোটিন গ্রহণ করে এবং মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়।একে নেশার দিক থেকে ১২তম অবস্থানে রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। যারা একটি খান তারা সহজেই এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ২০৩০ সালের মধ্যে নিকোটিনের কারণে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৮০ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে ধারণা করেন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা। ইঁদুরের দেহের নিকোটিন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এতে তাদের মস্তিষ্কে তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি ২৫-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।