প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে অপরাধের পরিমান, জেনে না জেনে ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে নানান রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। যেমনটি হয়েছে এই ছাত্রের সাথে। তড়িঘড়ি করে বাসে উঠতে গিয়ে এর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েল। আহত পায়েলকে সাহায্য না করে মৃত ভেবে তাকে নদীতে ফেলে দেয় ওই বাসের স্টাফরা। পায়েলের মৃত্যুর ক্লু খুঁজতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এদিকে, পায়েলের নিকটাত্মীয়দের দাবি, তাকে হত্যার পর মুখ বিকৃত করে নদীতে ফেলে দিয়েছে হানিফ পরিবহনের বাসটির স্টাফরা।
সোমবার (২৩ জুলাই) সকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর খাল থেকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দা ও কাতার প্রবাসী গোলাম মাওলার ছেলে সাইদুর রহমান পায়েলের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগের রাতে চট্টগ্রাম থেকে হানিফ পরিবহনের একটি এসি ডিলাক্স বাসে বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন পায়েল।
বাসচালক ও তার সহযোগীরাই পায়েলকে খুন করেছে বলে দাবি করেছেন তার মামা কামরুজ্জামান চৌধুরী টিটু। তিনি বলেন,‘বাসচালক ও তার সহযোগীরাই পায়েলকে হত্যা করেছে। আমাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। পায়েলের সঙ্গেও কারও শত্রুতা ছিল না।’তিনি জানান, পায়েল চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকায় তার মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তার বড় ভাই গোলাম মোস্তফা পলাশ বাবার সঙ্গে কাতারে থাকেন। বোনের বিয়ে হয়েছে।
কামরুজ্জামান চৌধুরী জানান, ‘আটক তিন জনের একজন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে পায়েলকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মামুন সাহেব আমাদের জানিয়েছেন, গ্রেফতারের পর বাসচালকের এক সহকারী স্বীকার করেছে, তারাই পায়েলকে হত্যা করে এবং পরে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তারা (বাসচালক ও সহযোগীরা) পুলিশকে জানায়, পায়েল দৌড়ে এসে বাসে উঠতে গিয়ে এর দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।
এসময় নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। চালকের সহযোগী জনি বিষয়টি বাসচালককে জানালে চালক স্টিয়ারিং থেকে নেমে এসে বলে,ছেলেটা তো মারা গেছে। তাকে এখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ঝামেলা হবে। এরপর তারা পায়েলের মুখ থেঁতলে দিয়ে লাশ দ্রুত নদীতে ফেলে দেয়।’
গত ২১ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে বন্ধুর সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন পায়েল। পুলিশ সূত্র জানায়, পথে রাত ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় গিয়ে যানজটে পড়ে বাসটি। এসময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাস থেকে নিচে নামেন পায়েল। এরপর থেকে আর পায়েলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ২৩ জুলাই সকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় হত্যাকারী সন্দেহে হানিফ পরিবহনের ওই বাসের চালক ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা হচ্ছে– বাসচালক জালাল, সুপারভাইজার ফয়সাল ও বাসচালকের সহকারী জনি।
কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন. ‘আটককৃত তিন জনের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, জবানবন্দিতে সে জানিয়েছে, তারা (বাসচালক ও সহযোগীরা) পায়েলকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে।’
বাসভর্তি যাত্রীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চালক ও তার সহযোগীরা কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটালো,জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হলেও এটিই সত্য,তারা আমার ভাগ্নেকে খুন করেছে।’
পায়েলের মামা বলেন,‘এসি গাড়ির বাইরে কিছু ঘটলে সাধারণত ভেতরে থেকে তা বোঝা যায় না। এর ওপর ঘটনা গভীর রাতে ঘটায় বাসযাত্রীরা ঘুমিয়েছিলেন। তবে বাসের বি-৩ ও বি-৪ সিটের দুই যাত্রী পায়েলকে নেমে যেতে দেখেন। পরে তাকে রেখে বাস ছেড়ে দিলে তারা চালককে পায়েলের কথা জিজ্ঞাসা করলে চালক তাদের জানায়,সে (পায়েল) আসবে না বলে জানিয়েছে।’
ওই দুই যাত্রীর একজন প্রাইম ব্যাংকে চাকরি করেন বলে জানান কামরুজ্জামান চৌধুরী। আর অন্য যাত্রী ওই ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী ছিলেন।
কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন,‘পায়েল ও তার বন্ধু হানিফ পরিবহনের ওই বাসের এ-৩ ও এ-৪ নম্বর সিটে বসে। তার সামনের সিট বি-৩,বি-৪। এই দুই সিটে ওই দুই যাত্রী বসে ছিলেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন,বাস যানজটে পড়লে পায়েল বাস থেকে নেমে যায়। যানজট ছেড়ে দিলে একটু সামনে গিয়ে বাসের চালক স্টিয়ারিং থেকে নেমে নিচে যায়। পরে নিচ থেকে এসে বাস ছেড়ে দিলে আমরা চালককে পায়েল বাসে ওঠেনি বলে জানালে সে আমাদের জানায়,ওই যাত্রী যাবে না।’
পায়েলের লাশ উদ্ধারের পর নিজে বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন গোলাম সরওয়ার্দী বিপ্লব। তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ-ই সত্য হলো। সুপারভাইজার জনি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছে, তারাই আমার ভাগ্নেকে হত্যা করেছে। তবে ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রথমে তারা মিথ্যা বলেছে। গজারিয়ার ভাটেরচরে বাস থেকে নেমেছিল পায়েল। কিন্তু তারা বলেছিল, পায়েল নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় বাস থেকে নেমেছিল।’
মুন্সীগঞ্জের আমলি আদালতের পরিদর্শক মো. হেদায়েতুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘সুপারভাইজার জনিকে হাজির করা হলে সে আদালতকে জানায়, সে, বাসচালক ও চালকের সহকারী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। পরে তাকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়।’
এ ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম পিপিএম বলেন, ‘ছেলেটি (পায়েল) বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হয়। বাসচালক ও সুপারভাইজার মনে করে, ছেলেটি মারা গেছে। কিন্তু তখনও সে মারা যায়নি। অথচ মারা গেছে ভেবে বাসের স্টাফরা ছেলেটিকে নদীতে ফেলে দেয়।’ এ ব্যাপারে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রেস কনফারেন্স করে বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার।