২০০০ সালের শুরু দিকে যুক্তরাজ্যে যান বাংলাদেশি তরুণ সাইফুল সুজন। সাবেক গ্লামারগন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। সাইফুল বাসা বাঁধেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের উত্তর কার্ডিফের পন্টিপ্রিড শহরে। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল, বিদেশ-বিভুঁইয়ে পায়ের নিচে শক্ত জমি খুঁজে পাওয়া। অথচ এর ১০-১৫ বছরের মধ্যেই ভয়ংকর জঙ্গিতে পরিণত হন এই বাংলাদেশি। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে মৃত্যু হয় সাইফুলের।
যুক্তরাজ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে কীভাবে একজন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন সাইফুল। গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস। পরে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেই জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থায়ন শুরু করেন তিনি। এ জন্য সাইফুল একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আইএসের উগ্রবাদে বিশ্বাসী জঙ্গিদের কাছে অর্থ পাঠানো হতো। এই অর্থ ব্যবহার করেই সন্ত্রাসী হামলার ছক হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে, হামলা হয়েছে বাংলাদেশেও!
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আলোচনায় আসেন সাইফুল সুজন। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন মুখপাত্র কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন ভিডিওবার্তায় দেওয়া এক ঘোষণায় জানিয়েছিলেন, ইরাক ও সিরিয়ায় চালানো ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের ১০ জন জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সাইফুল সুজন। বলা হয়, ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ার রাকায় চালানো হামলায় নিহত হন এই বাংলাদেশি নাগরিক। কর্নেল ওয়ারেন বলেছিলেন, সাইফুল আইএসের প্রধান হ্যাকার ছিলেন এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির অস্ত্রশস্ত্রের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতেন। এসব বিষয়ে আইএসের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন সাইফুল। একই সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের চালানো নজরদারি ব্যবস্থা এড়ানোর বিষয়টিও দেখভাল তিনিই করতেন।
২০১৫ ও ২০১৬ সালে সাইফুলের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় প্রথম আলো। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইফুলের পুরো নাম সাইফুল হক (সুজন)। যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পরই আইএসের উগ্র মতবাদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। একসময় পুরো পরিবারকেই আইএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন সাইফুল। আইএসের জিহাদি মতাদর্শে জড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রী-সন্তান, বাবা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাঁর পরিবারের সদস্যরা কিছুদিন খুলনায় থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকাতেই থাকছিলেন।
বিবিসি ওয়েলস কয়েক মাস ধরে যুক্তরাজ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, তিনটি মহাদেশজুড়ে চলেছে এই অনুসন্ধান। চলতি বছরের ১৬ জুলাই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওয়্যার ডেভিস। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেছে একজন সাধারণ ব্যবসায়ীর আইএসের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠার পেছনের গল্প। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ পাঠাতেন সাইফুল, দিতেন হামলার নির্দেশনা।
তরুণ উদ্যোক্তা যেভাবে জঙ্গি হলেন
২০০৫ সালের পরপর সাইফুল হকের সঙ্গে পরিচিত হন রব রিজ। তাঁর বাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন সাইফুল। রবের ভাষায়, সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আনতে চেয়েছিলেন সাইফুল। এ কারণে কার্ডিফে নিজস্ব একটি বাড়ি চাইছিলেন তিনি। তবে অর্থের সংকুলান করতে তাঁকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল।
বিবিসিকে রব রিজ বলেন, সাইফুল ছিলেন শান্ত স্বভাবের পরিশ্রমী একজন মানুষ। তিনি বলেন, ‘সাইফুল এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তাঁর কাঁধে হাত রাখার ইচ্ছা হবে আপনার। এ কারণেই আমি ও আমার স্ত্রী তাঁর জন্য সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছিলাম। সে (সুজন) বেশ দুর্বল ও অসহায় প্রকৃতির ছিল। মনে হচ্ছিল, কী করছে, সেই বিষয়ে সে ঠিক নিশ্চিত নয়।’
আত্মবিশ্বাসের অভাবে থাকা এই বাংলাদেশি তরুণই পরবর্তী কয়েক বছরে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হন। হয়ে ওঠেন পাকা ব্যবসায়ী। আইব্যাকস নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সাইফুল হক। কার্ডিফের বিভিন্ন এশীয় খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া শুরু করে আইব্যাকস। ওয়েলস বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সেও যোগ দেন সুজন। তিনি যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ওয়েলস থেকে বাংলাদেশে যাওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য দলের সদস্য ছিলেন।
২০০০ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান সাইফুল হক। সেখানে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি।
বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, ২০১০ সালের কাছাকাছি সময়ে ওয়েলসে আবির্ভূত হন সাইফুলের বড় ভাই আতাউল হক। দুই ভাই মিলে আইব্যাকসের ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর কাজ করতেন। এশীয় খাবার প্রস্তুতকারী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় সফটওয়্যার সলিউশন দেওয়ার পাশাপাশি চীন থেকে আনা বিল পরিশোধের যন্ত্র সরবরাহ করত আইব্যাকস। মূলত কার্ডিফের দক্ষিণ এশীয় রেস্তোরাঁগুলোতে আইব্যাকসের জমজমাট ব্যবসা ছিল।
ঠিক এই সময় থেকেই যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরের মতো কার্ডিফেও উগ্র মতবাদের অনুসারী মুসলিম তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বাড়ছিল। বিবিসি বলছে, ওই সময়ই জানা গিয়েছিল, কিছু ব্রিটিশ মুসলিম তরুণ-তরুণী দেশ থেকে পালিয়ে ইরাক-সিরিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের উগ্র মতাদর্শকে সমর্থন করে ভিডিওবার্তাও প্রকাশ করছিল তারা।
বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষের কাছে সাইফুলকে কখনোই ‘উগ্র বা গোঁড়া’ মনে হয়নি। নিজের কোনো কথাবার্তা বা লেখায় তিনি কখনোই ‘জিহাদি’ মনোভাব প্রকাশ করেননি। সুজনের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন থাকা স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁর মালিক এনাম উজজামান বলেন, ‘তাঁকে একেবারেই ধার্মিক মনে হতো না। বরং ব্যবসা ও রোজগার বাড়ানোতেই তাঁর মনোযোগ ছিল বেশি।’
বাংলাদেশে সাইফুলের বিয়ের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন এনাম উজজামান। তিনি বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে রক্ষণশীলতার কোনো লক্ষণই ছিল না। এনাম বলছিলেন, ‘সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এমন ছিল না যে নারীরা একদিকে, পুরুষেরা আরেক দিকে। দেশে আয়োজিত আর দশটা বিয়ের অনুষ্ঠান যেমন হয়, ঠিক তেমনি ছিল।’
প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, একই পরিবারে বিয়ে করেছিলেন সাইফুল ও তাঁর বড় ভাই আতাউল। ২০০৫ সালে সাইফুল তাঁর স্ত্রী সায়মাকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান। বড় ভাই আতাউলের স্ত্রী সন্তান জন্মের সময় মারা যাওয়ার পর থেকে সাইফুল ক্রমেই ধর্মভীরু হয়ে ওঠেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে, বড় ভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনাই সাইফুলকে বদলে দেয়। অনুমান করা হয়, ২০১২ সালে এ ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে দাড়ি-গোঁফ কামানো সাইফুল লম্বা জোব্বা ও পাগড়ি পরতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে উগ্রপন্থার আর্থিক পৃষ্ঠপোষক ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহকারী হন সাইফুল হক।
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের অধিবাসী মোহাম্মদ এলসহিনাউয়িকে নিয়মিত অর্থ পাঠাত সাইফুলের কার্ডিফভিত্তিক কোম্পানি। মোহাম্মদ এলসহিনাউয়ির ছবিটি ফেসবুক থেকে নেওয়া
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের অধিবাসী মোহাম্মদ এলসহিনাউয়িকে নিয়মিত অর্থ পাঠাত সাইফুলের কার্ডিফভিত্তিক কোম্পানি। মোহাম্মদ এলসহিনাউয়ির ছবিটি ফেসবুক থেকে নেওয়া
সাইফুলের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার ছক
যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদি কর্মকাণ্ড বিষয়ে তদন্ত করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই ২০১৫ সালে জানতে পারে, বাল্টিমোরের অধিবাসী মোহাম্মদ এলসহিনাউয়ি নামের এক ব্যক্তিকে নিয়মিত অর্থ পাঠায় সাইফুলের কার্ডিফভিত্তিক কোম্পানি। সব মিলিয়ে আট হাজার ডলার পাঠানোর হিসাব পায় এফবিআই। তদন্তে আরও জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য এই অর্থ পাঠানো হতো। শুধু অর্থসহায়তাই নয়, সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হতো আইব্যাকসের পক্ষ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত শিক্ষাবিদ ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সেইমাস হিউজ বিবিসিকে বলেন, মোহাম্মদ এলসহিনাউয়িকে হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এফবিআইয়ের এই তদন্ত নিয়ে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন সেইমাস হিউজ। তিনি বলেন, এলসহিনাউয়িকে দিয়ে বাল্টিমোরে বড় ধরনের হামলা চালানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল।
এ ঘটনায় প্রায় দুই বছর ধরে তদন্ত চালিয়েছে এফবিআই। তদন্তে জানা যায়, এ সময় এলসহিনাউয়িকে ১৬টি ভিডিওচিত্র পাঠিয়েছিলেন সাইফুল হক। এসবের মধ্যে বোমা বানানোর নির্দেশিকামূলক ভিডিও ছিল। বাল্টিমোরের ফেডারেল আদালত ভবনে হামলার পরিকল্পনা ছিল এলসহিনাউয়ির। গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ আনা হয় এবং চলতি বছরের শুরুর দিকে আদালত তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
সেইমাস হিউজ বলছেন, এলসহিনাউয়িকে উগ্রপন্থায় জড়াতে আইএস অভিনব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল। এর কেন্দ্রে ছিল সাইফুলের প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস। বিভিন্ন শেল কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাঠানো হতো। আর সেই অর্থ খরচ করা হতো সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনায়।
মোহাম্মদ এলসহিনাউয়ির মামলায় আদালতের নথি ও এফবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছে বিবিসি। তাতে জানা গেছে, সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইএসের জন্য প্রযুক্তি সরঞ্জাম কিনত আইব্যাকস। সাইফুলের কোম্পানি সামরিক কাজে ব্যবহারযোগ্য নজরদারি সরঞ্জাম কিনত। কেনা হতো ড্রোন সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিও। পরে জাহাজে করে তা পাঠানো হতো সিরিয়া ও ইরাকে।
বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা সামরিক সরঞ্জাম আইব্যাকসের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। কারণ প্রতিষ্ঠানটি শুধু কেটারিং ব্যবসায় প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে থাকে।
এফবিআইয়ের তদন্তে বিশেষভাবে উঠে এসেছে দুই ব্যক্তির নাম। তাঁরা হলেন সাইফুলের বড় ভাই আতাউল হক ও আবদুল সামাদ। দ্বিতীয়জন পেশায় একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ও আইব্যাকসের কর্মী। এফবিআই বলছে, আবদুল সামাদ আইএসের সক্রিয় সমর্থক এবং সাইফুলের নির্দেশেই বাল্টিমোরে অর্থ পাঠাতেন তিনি। একই সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম কেনাকাটায় জড়িত ছিলেন সামাদ। আর এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন একজনই—তিনি হলেন সাইফুল হক (সুজন)।
আবদুল সামাদ। এফবিআই বলছে, আবদুল সামাদ আইএসের সক্রিয় সমর্থক এবং সাইফুলের নির্দেশেই বাল্টিমোরে অর্থ পাঠাতেন তিনি।
আতাউল, সামাদ কোথায়?
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে যুক্তরাজ্যে গিয়ে সাইফুলের ব্যবসায় যুক্ত হন সাইফুলের বড় ভাই আতাউল হক। পরে ঢাকায় আইব্যাকসের শাখা খোলার পর সেখানকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন আতাউল হক। তবে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ২০১৫ সালে স্পেনে চলে যান তিনি। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী স্পেনের নাগরিক।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন বিমান হামলায় সাইফুল নিহত হওয়ার দুদিন আগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ টাকা উদ্ধার করে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। সন্ত্রাসবাদের জন্য অর্থ আদান-প্রদানের কাজে প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের অভিযোগে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরু থেকেই আতাউলের ওপর নজরদারি করেছে স্পেনের পুলিশ। সাইফুলের কোম্পানি আইব্যাকসের মতো একই ধরনের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেনে গড়ে তোলেন আতাউল। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘আইসিংকটেল’।
স্প্যানিশ তদন্ত সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে জানিয়েছেন, আতাউলের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রচলিত নিয়মে বৈধ ছিল। কিন্তু সাইফুলের মতো তারও উদ্দেশ্য ছিল আইএস-কে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া। আইএসের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন আতাউল। ধারণা করা হয়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পাঠিয়েছিলেন আতাউল এবং সেখানে সন্ত্রাসী হামলা চালানোই ছিল এর উদ্দেশ্য।
বিবিসির বলছে, গত বছর থেকে আইএস ড্রোন প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সাইফুল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিহত হওয়ার পর আইএসের প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহের কাজে জড়িত ছিলেন আতাউল। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর তাকে আটক করে স্পেনের পুলিশ। বর্তমানে কারাগারে আটক আছেন তিনি। চলতি বছরের শেষের দিকে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হতে পারে। অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন আতাউল।
স্প্যানিশ তদন্তকারীদের দাবি, উগ্রপন্থায় যেসব ব্যক্তি প্রকাশ্যে তা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন, তাদের তুলনায় আতাউল ও সাইফুল অনেক বেশি বিপজ্জনক। এই দুজনের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে নিষ্ক্রিয় করতে লেগেছে ছয়টি বছর এবং চারটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছে।
অন্যদিকে এফবিআইয়ের তদন্তে সাইফুল হকের সহযোগী হিসেবে যে আবদুল সামাদের নাম বারবার উঠে এসেছে, তিনি এখনো আছেন যুক্তরাজ্যে। ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় সাইফুলের ওপর ড্রোন হামলা চালানোর দিনই যুক্তরাজ্যে আটক করা হয় সামাদকে। কিন্তু কিছুদিন পর ছাড়া পান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও আনা হয়নি।
এ বিষয়ে আবদুল সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি ওয়েলস। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নে সহযোগিতার অভিযোগ সম্পর্কে সামাদ বলেন, তিনি কোনো অপরাধে যুক্ত নন এবং যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নন। তাঁর দাবি, কোম্পানির জন্য বৈধ যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনেছিলেন তিনি।
বিবিসির দাবি, ২০১৭ সালে সাইফুলের বড় ভাই আতাউলকে নতুন কোম্পানি খোলার বিষয়ে সহায়তা করেছিলেন সামাদ। তবে সামাদ বারবারই সন্ত্রাসবাদে সহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করছেন। বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বছর আতাউল গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন আগে আইসিংকটেল গড়ে তোলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আইএস-কে অর্থ সহায়তা ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহ করাই এর মূল কাজ।
বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ওয়্যার ডেভিস বলছেন, সাইফুল হক (সুজন) যে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, সুজন নিহত হওয়ার পরও তা অকার্যকর করতে দুই বছর সময় লেগেছে। এর প্রকৃতি দেখেই বোঝা যায়, এই নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত ও জটিল ছিল।