ঢাকায় মাদকের রাজকুমারী পাপিয়া

ফারহানা আক্তার পাপিয়া। শৈশব কাটিয়েছেন মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার কোয়ার্টারে। হাইস্কুলে পড়ার সময় প্রেমে পড়েন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন জয় ওরফে পাঁচুর। জেনেভা ক্যাম্পের বি-ব্লকের ২৩৯ নম্বর বাসায় ওঠেন পাঁচুর স্ত্রী হয়ে। এরপর জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। পাপিয়ার মাদকের হাতেখড়ি স্বামীর মাধ্যমেই। এক সময় স্বামীকে টেক্কা দিয়ে নিজেই ধরেন ব্যবসার হাল। অল্পদিনেই মাদক ব্যবসায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন পাপিয়া।

শুরুটা হেরোইন ও গাঁজা বিক্রি দিয়ে হলেও ধীরে ধীরে ইয়াবার ডিলারে পরিণত হন। নিজের রূপ-লাবণ্য আর অর্থ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করেন। ফারহানা মুছে গিয়ে মাদকের জগতে তার নতুন নাম হয় রাজকুমারী। ইয়াবা পাপিয়া হিসেবেও তাকে চেনেন দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। সন্দেহের বাইরে থাকতে তরুণী, বৃদ্ধা এমনকি শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলেন মাদকের বিশাল সিন্ডিকেট। পুলিশ এমনকি প্রতিপক্ষের হামলা প্রতিহত করতে সব সময় তার কোমরে গোঁজা থাকত অত্যাধুনিক পিস্তল-রিভলবার। থাকত দেহরক্ষীও। জেনেভা ক্যাম্পের বাইরে থেকেই মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এক সময়ের বস্তির মেয়ে পাপিয়া আজ কোটি কোটি টাকার মালিক।

অবশেষে ইয়াবা, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ শীর্ষ এই মাদক রাজকুমারী পাপিয়া (২৫) ও তার স্বামী পাঁচুকে (২৯) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫ রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। যদিও এর আগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পাপিয়া। তবে আইনের ফাঁক গলে জামিনে এসে ফের জড়িয়ে পড়েন ইয়াবার র্যাকেটে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাতে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা থেকে পাপিয়া ও পাঁচুকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ। এই দম্পতির বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর ও মতিঝিলসহ কয়েকটি থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে বেশকিছু মামলা রয়েছে। প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের তত্ত্বাবধানে পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দেন এডিসি রহমত উল্যাহ চৌধুরী।

পুলিশ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন টিম লালবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচু ও পাপিয়াকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের তথ্য অনুযায়ী লালবাগ এলাকার গোপন আস্তানা থেকে জব্দ করা হয় আরও ১০ হাজার ইয়াবা, একটি আগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচটি গুলিসহ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক।

জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, ইকবাল রোড, পুরান থানা রোড, জহুরি মহল্লা, জয়েন্ট কোয়ার্টার, টিক্কাপাড়া, কৃষি মার্কেট, পাকা ক্যাম্প, পিসিকালচার ও শেখেরটেকের মানুষ এককথায় জিম্মি ছিলেন। চট্টগ্রামের হোসাইন নামে এক মাদক ব্যবসায়ী পাপিয়ার ভাসুর রাহীর কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতেন। পরে সেগুলো পাঁচু ও পাপিয়া রাজধানীতে সরবরাহ করতেন। কয়েক বছর আগে জেনেভা ক্যাম্পের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ পাপিয়া ও তার ভাসুর রাহীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিন্তু কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ক্যাম্প ছেড়ে তারা বাসা নেন শ্যামলী হাউজিং সোসাইটিতে। পরবর্তী সময়ে আদাবরের শেখেরটেকের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির বাসা থেকে পিস্তল, বিপুল ইয়াবা ট্যাবলেট ও হেরোইনসহ পাপিয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।

আরও জানা গেছে, নারী-পুরুষসহ পাপিয়ার অন্তত ৩০০ জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। যাদের কাজ মাদক বিক্রি, হামলা ও তরুণীদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে অথবা মাদক ব্যবসায় বাধা দিতে আসা সাধারণ মানুষকে মামলায় ফাঁসানো। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে তার রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। যে কারণে কোনো অভিযানের খবর আগেই জেনে যেতেন পাপিয়া। কেউ পাপিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলে তাকেও পুলিশ দিয়ে হয়রানিসহ মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। পাপিয়ার পাতানো ফাঁদে কারাগারে যেতে হয়েছে তারই ভাসুরের ছেলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী পলুকে।

এদিকে জেনেভা ক্যাম্পের অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী পঁচিশের হয়ে কাজ করতেন পাপিয়ার স্বামী পাঁচু। পাঁচুর নামে একাধিক মামলা থাকায় জেনেভা ক্যাম্পে বৃদ্ধ মাকেও দেখতে আসতেন না। এদিকে পাঁচুর অনুপস্থিতিতে র্যাবের কথিত সোর্স ফারুকের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন পাপিয়া। মাওয়া রোডে বিশাল জমির মালিক পাপিয়া। এ ছাড়াও ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট। রয়েছে নামে-বেনামে অনেক সম্পদ। এতকিছু থাকার পরও তিনি থাকতেন ভাড়া বাসায়। আদাবর, শ্যামলী আর জহুরি মহল্লায় আট-দশটি ভাড়া বাসা রয়েছে পাপিয়ার। যেখানে এতদিন তিনি চালিয়ে আসছিলেন মাদক ব্যবসায় ও অনৈতিক কর্মকা-। পর্দার আড়ালে থেকেই মাদক ছাড়াও কিলিং নেটওয়ার্ক চালাতেন এই দম্পতি।