সৌদি আরবে অনেক অমুসলিম রমজানে রোজা পালন করেন। দেশটির সাড়ে ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ লাখ মানুষ রয়েছেন যাঁরা অভিবাসী। তাঁরা নানা কাজে সৌদিতে অবস্থান করেন। তাঁদের অধিকাংশই অমুসলিম।
রোজা পালনের কারণ হিসেবে এই অমুসলিমেরা বলেন, এতে তাঁরা মুসলিম বন্ধু ও সহকর্মীদের আরও কাছাকাছি আসতে পারেন। রমজান মাসে বিচ্ছিন্ন বোধ করেন না। এতে তাঁদের মধ্যে আরও বেশি সখ্য গড়ে ওঠে।
এ বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরবভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আরব নিউজ গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সৌদিতে কর্মরত রাফায়েল জেগার নামের এক ফরাসি বলেন, ‘রমজান শুধু নিজের জন্য নয়, এটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। বন্ধুত্ব ও উদারতা ভাগাভাগি করার এটি একটি আদর্শ সময়। আমি এই সুন্দর চর্চার অংশীদার হতে চাই। সৌদি এবং ফরাসি সংস্কৃতির মেলবন্ধনে কাজ করে যেতে চাই।’
‘প্রথমবার যখন রোজা পালন করি তখন অনেক পিপাসা লেগেছিল। এটি কষ্টসাধ্য হলেও আমি গর্ব বোধ করেছি’, যোগ করেন রাফায়েল জেগার। রোজা রাখার বিষয়টিকে তিনি শরীরচর্চা কেন্দ্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করেন।
আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, রমজানে রোজা পালনের আধ্যাত্মিক অনেক মাহাত্ম্য আছে। এর সঙ্গে রোজা পালনের স্বাস্থ্যগত কিছু উপকারের দিকও রয়েছে। রমজানে শরীর কম খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এটি পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতায় কাজে দেয়। সরাসরি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করার কারণে ক্ষুধা কমে যায়। ওজন কমাতেও ভূমিকা রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকা কোলেস্টেরল উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা হৃদ্যন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মাসব্যাপী রোজা পালনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে জমে থাকা টক্সিন পরিষ্কার হয়ে যায়। রোজা পালন ও দেরিতে খাবার গ্রহণের ফলে অ্যাডিপোনেক্টিন হরমোন বেশি তৈরি হয়, যা পেশিগুলোকে অতিরিক্ত পুষ্টি শোষণ করতে দেয়।
খাবার থেকে বিরত থাকার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়, যা শরীরকে শক্তির জন্য সঞ্চিত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে সাহায্য করে। ফলে শরীর স্বাভাবিকভাবেই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শারীরিক নানা উপকারের পাশাপাশি রোজা পালনে মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়।
মারিয়া রোস (২১) নামের এক মার্কিন অমুসলিম তরুণী নিজে রোজা রাখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন প্রথম বিদেশ সফরে তুরস্কে যাই, তখন থেকেই রোজা পালন করি। আমি আমার এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলাম। তখন আমরা রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নিই। তুরস্কে রমজান মাস চলার সময়টায় আমরা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বেশ উপভোগ করেছি।’
আরব দেশগুলোতে ভ্রমণের সময় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার রোজা পালন করেছেন বলে জানান এই মার্কিন তরুণী। তিনি বলেন, ‘আমি সেই রমজানে প্রতিদিন আমার বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করেছি। কখনো আমরা বাইরে ইফতার করতাম। কখনো আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই ইফতার করতাম।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক সৌদি মুসলিম যুবককে বিয়ে করেন রোস। এখন তাঁর সঙ্গেই প্রতিবছর রমজানে রোজা পালন করছেন।
জর্জিয়া থেকে আগত আনা মাইলোভা আরব নিউজকে বলেন, ‘সৌদি আরবে আসার পর থেকেই রোজা রাখছি। আমি আমার বন্ধু হাইফারের পরিবারের সঙ্গে রোজা পালন করি। তাঁরা এখন আমার পরিবারের মতোই। প্রতিদিনই ইফতারের সময় ভিডিও কলে আমি পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইফতারের সুন্দর আয়োজন তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করি। আপনারা যদি সৌদি আরবে আসার পরিকল্পনা করেন তাহলে এই ইফতারের খাবারগুলো মিস করবেন না।’
মাইলোভার আশা, আরও অনেক মানুষ রমজানে সৌদি আরব ভ্রমণে উৎসাহিত হবে।
জার্মান কূটনীতিক জান হাস (৩৪) আরব নিউজকে বলেন, তিনি সৌদি আরবের মিনায় তাঁর প্রথম রোজা পালন করেছেন।
জান হাস বলেন, ‘আমার ফুটবল দলে অনেক বন্ধু ছিল যারা মুসলিম। তখন আমি জার্মানির কোলনে পূর্বের একটি ছোট শহরে থাকি। আমি ছোটকাল থেকেই রমজানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, কিন্তু তখন রোজা রাখার কথা ভাবিনি।’
সৌদি আরবে রমজান মাসে রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় এখানে রোজা রাখাটা সহজ বলে মন্তব্য করেন জান হাস।
ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠায় সংস্কৃতির আদানপ্রদান ঘটছে বলে আরব নিউজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।