‘আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে মা গুলি খায়’

‘বাবার কাছে শুনেছি যে আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়েই মা গুলি খেয়ে মাঠে পড়ে গিয়েছিল। আমি নাকি বেশ কয়েকদিন আমার মৃত মায়ের গায়ের ওপরেই পড়েছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে খুঁজে পায়,’ বলেছিলেন বসুন্ধারি গ্রামের জোহরা খাতুন।

ভারতে আসামের নির্বাচন কভার করতে ২০১৪ সালে গিয়েছিলাম আসামের নেলি অঞ্চলে। জোহরা খাতুনের মুখের সামনে মাইক ধরেছিলাম তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। কথা বলার সময় ছলছল করছিল তার চোখ।

জোহরা খাতুনকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে যেদিন গুলি খেয়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল, তা আজ থেকে ঠিক ৪০ বছর আগের ঘটনা।

তিনি জোহরা খাতুন তখন ছয় মাসের শিশু।

পরিকল্পিত গণহত্যা

আসামের তৎকালীন নগাঁও জেলার (বর্তমানে মরিগাঁও) নেলি অঞ্চলে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সালে ঘটে গিয়েছিল এক ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’। একবেলার মধ্যে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তিন হাজারেরও বেশি বাংলাভাষী মুসলমানকে।

বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা অবশ্য ১০ হাজারেরও বেশি। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল শত শত ঘরবাড়ি।

ওই সময়ে নেলিই ছিল স্বাধীন ভারতের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা।

পরলোকগত সাংবাদিক হেমেন্দ্র নারায়ণ ওই নারকীয় হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

হেমেন্দ্র নারায়ণ তার বইয়ে লিখেছিলেন, ‘একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম আমরা। আওয়াজটা খুব স্পষ্ট, কিন্তু বাচ্চাটিকে আমরা দেখতে পাইনি।’

হয়ত ভয়ার্ত ছোট্ট জোহরা খাতুন বা তার মতই কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজই ওই ভয়াল সকালে শুনতে পেয়েছিলেন তিনি।

ওই কান্নার আওয়াজ পাওয়ার আগেই আরেকটি বাচ্চা ছেলেকে জবাই হওয়ার হাত থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যেতে দেখেছিলেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

বাচ্চা ছেলেটি হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল

ঘটনার ২৫ বছর পরেও ওই বাচ্চা ছেলেটির কথা স্পষ্ট মনে ছিল তার। হেমেন্দ্র নারায়ণ একটা বই লেখেন, ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অন.. নেলি স্টিল হন্টস’ নামে।

ওই বইতে হেমেন্দ্র নারায়ণ লিখেছেন, ‘যেন একটা খরগোশ যাচ্ছে, সেভাবেই বাচ্চা ছেলেটি এগোচ্ছিল। ছয় কি সাত বছর বয়স হবে তার। তাকে দেখে আমাদের পা এগোয়নি আর, বড়জোর ৩০ থেকে ৪০ মিটার দূরে ছিলাম আমরা। আমাদের মাঝে দেমাল বিল। সে কেন ওইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল, তা কয়েক মুহূর্ত পরে বুঝেছিলাম। বিপদ এগিয়ে আসছিল তার দিকে। ধুতি পরা একজন দা হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছিল।’

হেমেন্দ্র নারায়ণ লিখেছেন, ‘যে লোকটি ওই শিশুটির দিকে এগোচ্ছিল তিনি ওই হত্যাকারী দলেরই সদস্য ছিল। তাদের শিকারদের তাড়া করে পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল তিনি। অন্য দিকে বাচ্চা ছেলেটি তার পরিজনদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিল। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছিল। ছেলেটি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ফসল কাটা হয়েছে সদ্য, তাই লুকনোর সুযোগ বিশেষ ছিল না।

লোকটির হাতের নাগালে যখন চলে এল বাচ্চা ছেলেটি, তখন হেমেন্দ্র নারায়ণরা দেখলেন সে তার দা-টা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল আর তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ছেলেটিকে একটা চড় মারল। একটা চাপা আর্তনাদ, তারপরেই বাচ্চা ছেলেটি মাটিতে পড়ে যায়।

হেমেন্দ্র নারায়ণ বুঝতে পারেননি কেন ওই একাকী বাচ্চা ছেলেটিকে দা হাতে থাকা লোকটি না কুপিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল।

হেমেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন ওই গণহত্যার তিন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের একজন। তিনি তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের আসামের সংবাদদাতা ছিলেন। আর ওই দিন অন্য যে দু’জন সাংবাদিক প্রত্যক্ষ করেছিলেন ওই গণহত্যা, তারা হলেন আসাম ট্রিবিউনের সাংবাদিক বেদব্রত লহকার আর অ্যামেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা এবিসির চিত্রগ্রাহক শর্মা।

সকাল ৭টায় বাড়ি জ্বালানো শুরু হয়

ঘটনাচক্রে ওই গণহত্যার সময়ে তারা তিনজন নেলিতে পৌঁছেছিলেন কোনো আগাম পূর্বাভাস ছাড়াই।

হেমেন্দ্র নারায়ণ বলেন, ‘আমরা তিনজন একটা গাড়ি নিয়ে গুয়াহাটি থেকে নগাঁওয়ের দিকে রওনা হয়েছিলাম ওই দিন সকালে। কোনো নির্দিষ্ট খবর জোগাড় করার কথা আমাদের মাথায় ছিল না। ওই উত্তাল সময়ে আসামে ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর পাওয়া খুব কঠিন ছিল না।

তার কথায়, ‘জাগি রোডের কয়েক কিলোমিটার পরে হঠাৎ দেখলাম একদল আদিবাসী হাতে নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে একটা ছোট টিলা থেকে নেমে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। আমার মন বলছিল একটা কোনো ঝামেলা হতে পারে, আমাদের থামা দরকার। যখন তিনজনে থামার সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা ধর্মাতুল সেতুর কাছাকাছি। নেলি থেকে একটু দূরে। আমরা হেঁটে এগোতে লাগলাম।’

তিনি লিখেছেন, কয়েকশো আদিবাসী জড়ো হয়েছিল, তাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র। কয়েকজনের হাতে বাঁশের মাথায় কাপড় জড়ানো। তারা ‘জয় আঈ অহ‘ স্লোগান দিচ্ছিল, যার অর্থ ‘আসাম মাতার জয়।’

নারায়ণ ও অন্য দুই সাংবাদিক ওই আদিবাসীদের সাথে যখন কথা বলছিলেন, ততক্ষণে জোহরা খাতুনদের গ্রাম বসুন্ধারির মুহম্মদ আব্দুল হকের বাড়ির পিছনে চাষের জমিতে জড়ো হয়ে গেছে গ্রামের নারী পুরুষ আর শিশুরা।

ওই ঘটনার কথা মনে আছে মুহম্মদ আব্দুল হকের।

আমাকে ২০১৪ সালে মুহম্মদ আব্দুল হক বলেছিলেন, ‘সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি-ঘর জ্বালানো শুরু হয়েছিল। গ্রামের দু’প্রান্ত থেকেই ঘর জ্বালাতে জ্বালাতে এগোচ্ছিল ওরা। সব মানুষ আমার বাড়ির ঠিক পিছনের ক্ষেতে জমা হয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি থেকে অস্ত্র হাতে লোকজন নামছে, মুখে গামছা বাঁধা। তারপরেই শুরু হয়েছিল গুলি আর তীর ছোঁড়া’

আব্দুল হক নিজেও স্ত্রী, ছেলে আর মেয়েকে হারিয়েছেন ওই গণহত্যায়।

পাশের গ্রাম বুকডোবা হাবির বাসিন্দা মুসলিমুদ্দিদেরও পাঁচ বছরের মেয়ে, স্ত্রীসহ প্রায় পুরো পরিবারই ওই দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

পাশাপাশি দুটি গ্রামেই মারা গিয়েছিলেন দুই হাজার ছয় শ’র বেশি মানুষ।

আবার বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের কোলে চা বাগান ঘেঁষা গ্রাম বরবরিতেও একই সময়ে চলছিল হামলা। হত্যা করা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ শ‘ নারী-পুরুষ-শিশুকে। প্রাণে বাঁচার জন্য দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই দৌড়িয়েছিলেন ওই দিন।

সেই সবুজ শাড়ি পরা নারী

সবুজ শাড়ি পরা এক মাকে দেখতে পেয়েছিলেন হেমেন্দ্র নারায়ণ আর তার দুই সাংবাদিক বন্ধু।

তার ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অন.. নেলি স্টিল হন্টস’ বইতে একটি পরিচ্ছেদের নামই দিয়েছেন তিনি ‘ওম্যান ইন গ্রিন শাড়ি’, অর্থাৎ ‘সেই সবুজ শাড়ি পরা নারী’।

হেমেন্দ্র নারায়ণ লিখেছেন, ‘আমরা যখন তাকে দেখি, তিনি একটা শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে আরেকটি সন্তানের হাত ধরে টানতে টানতে দৌড়াচ্ছিলেন। পিছনে দৌড়াচ্ছিল তার আরেক সন্তান। সবুজ শাড়ি পরা ওই নারীর গলা দিয়ে একটানা অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরচ্ছিল। এবিসির ক্যামেরাম্যান শর্মা যখন ছবি তোলার জন্য ওই নারীর দিকে তার টিভি ক্যামেরাটা ঘোরালেন, তখন ওই নারীর আর্তনাদ আরো বেড়ে গেল।’

ওই নারী আর তার সন্তানরা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু দেমাল বিলে ভাসতে থাকা আরেক নারীর সে সৌভাগ্য হয়নি। তাকে হত্যাকারীরা বল্লম দিয়ে চিরে দিয়েছিল।

বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে ওই হত্যালীলা দেখার পর হেমেন্দ্র নারায়ণরা যখন ফেরার পথ ধরছেন, তখন তারা দেখা পেয়েছিলেন একদল কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ সদস্যের, কিন্তু তারা বেশ ধীরে সুস্থে হাঁটছিলেন, হত্যাকারীদের ধরার জন্য কোনো তাগিদ তাদের ছিল না বলেই মনে হয়েছিল সাংবাদিকদের ওই দলটির।

দলাপাকানো কিছু লাশের ওপরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম

ঘটনার তিন দিন পরে গ্রামে ফিরতে পেরেছিলেন বসুন্ধারির বাসিন্দা আব্দুল সোবহান। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের কবরস্থানে।

আমাকে তিনি বলেন, ’দিন তিনেক পরে যখন গ্রামে আসতে পারলাম, দেখি যাকে যেভাবে পেরেছে কবর দিয়েছে। কারো হাত বেরিয়ে আছে, কারো পা। রাতে নিরাপত্তা বাহিনীই কবর দিয়েছে। পরে আমরা সেগুলোর ব্যবস্থা করে মৃতদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করি।’

ঘটনার এক দিন পর, ১৯৮৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসেরই আরেক সাংবাদিক শেখর গুপ্তা গিয়েছিলেন নেলিতে।

ওই দিনের কথা তিনি লিখেছিলেন পরের বছর তার প্রকাশিত ‘আসাম : আ ভ্যালি ডিভাইডেড’ বইয়ে। বইটির কিছু বাছাই করা অংশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্যা প্রিন্ট’ সংবাদ পোর্টালে।

শেখর গুপ্তা লিখেছিলেন, ‘দলাপাকানো কিছু লাশের ওপরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করি লাফিয়ে-ডিঙ্গিয়ে যেতে, পঁচা বাধাকপির মতো ছড়িয়ে থাকা দেহ বা দেহাংশগুলোতে পা পড়ে যাচ্ছিলই।’

তার মিনোলটা ক্যামেরা দিয়ে ছবিও তুলছিলেন শেখর গুপ্তা। সাথে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ১০ নম্বর ব্যাটালিয়নের সাব ইন্সপেক্টর তাড়া দিচ্ছিলেন গুপ্তাকে, ‘আপনি এক জায়গায় এত সময় নষ্ট করলে চলবে? ওদিকে আরো শত শত লাশ পড়ে আছে যে!’

শেখর গুপ্তা এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ২৫৬টি লাশ গুনতে পেরেছিলেন।

শেখর গুপ্তা লিখেছেন, ‘আরেকটি গ্রাম মুলাদারি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তাটা জুড়েই যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। দেহের নিচের অংশ একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা এক নারী চিৎকার করছিলেন। তার বুক থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। গ্রামের যে কয়েকজন বেঁচে ছিলেন, আব্দুল হান্নান তাদের অন্যতম। তিনি বলেছিলেন, ওই নারী ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। তার যোনিতে বল্লমের হাতল ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তার গর্ভপাত হয়ে গেছে। হত্যাকারীরা যাওয়ার আগে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে।’

আঙুল তুলে তিনি গুপ্তাকে পাশের দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ওই নারীর প্রথম সন্তান, দু’বছর বয়স। তাকে দু’ভাগে চিরে দিয়েছে।’

আব্দুল হান্নানকে উদ্ধৃত করে শেখর গুপ্তা লিখেছিলেন, ‘ওর দুটি হাত দু’দিক থেকে দু’জন করে ধরে মাঝামাঝি চিরে দিয়েছে।’

কারা ঘটিয়েছিল ওই হত্যালীলা?

আবারো ফিরে যেতে হবে হেমেন্দ্র নারায়ণের লেখায়।

তাদের তিন জনের সাথে যখন হত্যাকারীদের প্রথমবার দেখা হয়েছিল, তারা নারায়ণদের বলেছিল যে অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী, যাদের বিদেশী বলে তার আগেই দাগিয়ে দিয়েছিল অসমীয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু), তাদের কারণে আসামের বাসিন্দা ওই আদিবাসীরা নিজভূমেই পরবাসী হয়ে গেছে।

আসুর স্লোগান ‘জয় আঈ অহম’ও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন হামলাকারীদের গলায়।

যে সময়ে নেলির গণহত্যা ঘটে, তা ছিল আসামে নির্বাচনের সময়। ঘটনার কয়েকবছর আগে থেকেই আসাম আন্দোলনের ফলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজ্য। তার মধ্যেই নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। আসুসহ অসমীয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো বয়কট করেছিল নির্বাচন।

ওই সময়ে আসামে যারা সাংবাদিকতা করতেন, তাদের কাছে শোনা যায় নিয়মিতই ‘জনতা কার্ফু’, ‘জনতা হরতাল’ ইত্যাদি ডাকত আসু। দেয়ালে যেসব স্লোগান লেখা হত, তার মধ্যে এমন স্লোগানও থাকত যে যারা ভোট দেবে, তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের রক্তে রাস্তা রাঙিয়ে দেয়া হবে।

’বিদেশী’ ইস্যুতে আসু পাশে পেয়ে গিয়েছিল আসামের আদিবাসীদের এক অংশকে।

ভোট যত এগিয়ে আসতে লাগল, প্রশাসন ততই বুঝতে পারছিল যে স্থানীয় সরকারি কর্মচারীরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন না। তাই অন্য রাজ্য থেকে সরকারি কর্মচারী, অন্য রাজ্যের পুলিশ নিয়ে আসা হয়েছিল।

চার শ’ কোম্পানি কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী আর সেনাবাহিনীর ১১টা ব্রিগেড নামানো হয়েছিল ওই নির্বাচনে।

ওই সময়ে আসাম পুলিশের আইজি আইনশৃঙ্খলা ছিলেন কে পি এস গিল। নেলি গণহত্যার অনেক পরে এক অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে ৬৩টি বিধানসভা আসনে ভোট নির্বিঘ্নে করানো সম্ভব ছিল, আর ২৩টা এমন আসন ছিল যেখানে ভোট করানো অসম্ভব ছিল। নেলি এলাকা দ্বিতীয় আসনগুলির মধ্যে পড়ত।

কিন্তু নেলিতে ভোট নেয়া হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই অঞ্চলটির মুসলমানরা ঠিক করেছিলেন যে তারা ভোট বয়কটের ডাকে সাড়া দেবেন না।

তাই ভোটের আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল হুমকি।

কোথায় ছিল পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী?

গণহত্যার ঠিক আগের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন জাপানি গবেষক মাকিকো কিমুরা। দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি খুঁজে বের করেছেন ওই সময়ে নেলি ও আসামের পরিস্থিতি নিয়ে বহু প্রায় অজানা তথ্য। সেগুলো সবই তিনি লিখেছেন তার বই ‘দ্যা নেলি ম্যাসাকার অফ ১৯৮৩-অ্যাজেন্সি অফ রায়োটার্স’-এ।

ওই বই থেকেই জানা যায় যে ভোটের পর দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি নগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একটা বেতারবার্তা পাঠিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আগের রাতে খবর পাওয়া গেছে যে নেলি আর তার আশপাশের গ্রামগুলোর প্রায় হাজার খানেক অসমীয়া মানুষ মরণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছে। মুসলমানরা ভয় পাচ্ছে, যে কোনো সময়ে আক্রমণ হতে পারে। শান্তি বজায় রাখার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।’

নেলির গ্রামবাসীরা আমাকে ২০১৪ সালে জানিয়েছিলেন যে ঘটনার দু’দিন আগে গ্রামে পুলিশ গিয়েছিল। দু’পক্ষের মধ্যে বৈঠক করে শান্তি কমিটিও তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল তারা।

আর ১৭ ফেব্রুয়ারি রটে যায় যে স্থানীয় লালুং আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকটি শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। পর দিন সকাল থেকে শুরু হয় হত্যালীলা।

পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তখন ধারে কাছে দেখা যায়নি।

বসুন্ধারি গ্রামের বাসিন্দা মুহম্মদ আব্দুল হক বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী গণ্ডগোল আঁচ করতে পেরেছিল, গুলির শব্দও হয়তো শুনেছিল। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ বাহিনীকে গ্রামে না নিয়ে এসে অন্য দিকে টহল দেয়াচ্ছিল। পরে কয়েকজন নারী কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়িগুলোর পথ আটকালে তারা বুঝতে পারে যে কী ঘটছে ভেতরের গ্রামগুলোতে। দুষ্কৃতিকারীরা তখনই পালাতে শুরু করে।’

গণহত্যা আটকানো সম্ভব ছিল?

গণহত্যার পরে সরকার একটা তদন্ত কমিশন গড়েছিল প্রশাসনিক অফিসার টি পি তিওয়ারির নেতৃত্বে। তিওয়ারি কমিশন।

পরের বছর কমিশন সরকারের কাছে তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। পরের বছর ৫৪৭ পাতার রিপোর্ট জমা পড়ে সরকারের কাছে। কিন্তু ওই সময়কার কংগ্রেস দলীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে ওই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে না। তারপরে অসম গণপরিষদও একই সিদ্ধান্ত বজায় রাখে। এমনকি বিধানসভাতেও ওই রিপোর্ট পেশ করা হয় নি।

বহু বছর ধরে ওই তদন্ত রিপোর্টের মাত্র তিনটি কপি সরকারের কাছে রাখা ছিল, যদিও অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে তার ফটোকপি বলে কিছু কাগজ ঘুরত।

কয়েক বছর আগে সেন্টার ফর ইক্যুয়িটি স্টাডিজ তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় একটি আবেদন করে, যার ফলে ওই তদন্ত রিপোর্ট সামনে আসে।

তিওয়ারি কমিশন তিনজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপরে সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল। ওই যে ওয়্যারলেস বার্তাটি ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঠিয়েছিলেন নগাঁও থানার ওসি, সে কারণেই নাকি মূল গণ্ডগোলটা হয়েছিল, বাকি সরকারির কাঠামো ঠিকঠাকই কাজ করেছে, এমনটাই মন্তব্য করে তিওয়ারি কমিশন।

তাদের রিপোর্টে লেখা হয় বার্তাটি তিনি যাদের পাঠিয়েছিলেন, তারা সেগুলো পড়েই দেখেনি।

এদের দু’জনকে পরে সাসপেন্ড করা হয় কিছুদিনের জন্য, একজনেরও কোনো শাস্তিই হয়নি।

শাস্তি হয়নি হত্যাকারীদের কারো। যদিও ৬৮৮টি এফআইআর করা হয়েছিল, ২৯৯টির ক্ষেত্রে চার্জশিটও জমা পড়েছিল। কিন্তু সাজা হয়নি কারো।

স্বজনহারা পরিবারগুলোকে প্রত্যেক লাশের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা করে, আর কিছু ঢেউ টিন।

আসামের মানবাধিকারকর্মী আমন ওয়াদুদ বলছিলেন, ‘কয়েক হাজার পরিবার চার দশক ধরে অপেক্ষা করে আছে ন্যায় বিচারের আশায়। হয়তো এখনো সময় আছে, বিচার প্রক্রিয়াটা শুরু তো হোক অন্তত।’