সৌদি আরবে মক্কার আশেপাশে ধূসর মরুভূমির সবুজে পরিণত হওয়ার ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। স্যাটেলাইট দিয়ে ধারণ করা ছবি সৌদির আবহাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট প্রকাশ করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমনটি ঘটছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞগণ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মরুভূমির ধূসর পাহাড়-পর্বত সবুজে পরিণত হওয়াকে কেয়ামতের আলামত বলে দাবি করছেন অনেকেই। রাসুলুল্লাহ স.-এর ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করে অনেকে বলছেন, ‘কেয়ামত এসে গেছে’। আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো কেয়ামতের আলামত কী আর মক্কার মরু সবুজায়নের সাথে এর সম্পর্কই বা কী।
পৃথিবী সৃষ্টি করার পর তা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন মাজিদে। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় কেয়ামত। আল্লাহ তাআলা সুরা যুমারের ৬৮ নং আয়াতে বলেন, ‘শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে আসমান-জমিনের সবাই মূর্ছা যাবে, তবে আল্লাহ যাদের রক্ষা করতে চাইবেন, তারা ছাড়া। এরপর আবার শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকবে।’
এই কিয়ামত কবে হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য আল্লাহ ছাড়া আর কারও জানা নেই। তবে তাঁর প্রেরিত রাসুল স. কেয়ামতের ছোটো বড়ো বেশ কিছু আলামত বলে গেছেন। তাই হাদিসে বর্ণিত আলামতসমূহ দিয়ে বিভিন্ন ঘটনাবলিকে কেয়ামতের আলামত হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তাই এই ঘটানাটিকেও কেয়ামতের আলামত বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
হাদিসে কেয়ামতের বড়ো আলামত ১০টি বলে উল্লেখ করা হয়। যেমন— দাজ্জালের আবির্ভাব, ইমাম মাহদির আগমন, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া ইত্যাদি। আর ছোটো আলামতের সংখ্যা ৩০টির কাছাকাছি। প্রায় সব ছোটো আলামত এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন—মহানবি স.-এর জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনাও কেয়ামতের অন্যতম ছোটো আলামত। তেমনি মুসলমানদের বায়তুল মুকাদ্দাস ও কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ও ছোটো আলামত। ছোটো আলামতের মধ্যে এখনও পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি এমন একটি হলো আরব ভূখণ্ডে তৃণলতা ও নদী-নালা ফিরে আসা।
এ বিষয়ে তিনটি হাদিস পাওয়া যায়। প্রথম হাদিসে রাসুলুল্লাহ স. বলেন, ‘আরব ভূখণ্ডে তৃণভূমি ও নদী-নালা ফিরে না আসা পর্যন্ত কেয়ামত হবে না।’ দ্বিতীয় হাদিসেও একই শব্দগুলো এসেছে। তৃতীয় হাদিসে তাবুকের যুদ্ধের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে মহানবী স. তাবুক সম্পর্কে মুআজ ইবনে জাবাল রা.-কে বলেছিলেন, ‘হে মুআজ, তোমার আয়ু যদি দীর্ঘ হয়, তবে শিগগিরই তুমি এই স্থান জন-বসতি ও উদ্যানে ভরা দেখতে পাবে।’ (মুসলিম)
হাদিসগুলোর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, আরব উপদ্বীপের মরুভূমিগুলোতে কেয়ামতের আগে সবুজ তৃণলতা গজাবে এবং নদী-নালার সৃষ্টি হবে। হাদিসে যেহেতু ‘ফিরে আসবে’ এসেছে, তাই বোঝাই যাচ্ছে, প্রাচীন যুগের কোনো এক সময় আরবের মরু অঞ্চলে সবুজ তৃণভূমি ও নদী-নালা ছিল। কেয়ামতের আগে আবার আরবের সেই রূপ ফিরে আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে গবেষণা করে অনেক ভূতাত্ত্বিকই এটি নিশ্চিত হয়েছেন। (ইসলামওয়েব ডটকম)
প্রথম ও দ্বিতীয় হাদিসে মহানবি স. আরবে তৃণলতা ও নদী-নালায় ভরে যাওয়ার যে কথা বলেছেন, এটি তারই একটি সূচনা হতে পারে। তবে পুরোপুরি সেটি দৃশ্যমান বলা যাচ্ছে না। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, আরব ভূমিতে তৃণলতা ও নদী-নালা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, যেমনটি একসময় ছিল। সেই সময় এখনও আসেনি। তবে তা যে খুব শিগগিরই আসতে চলেছে, আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক আবহাওয়া ও জলবায়ু দেখলেই তা আঁচ করা যায়।
এছাড়া সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি ১ হাজার কোটি গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে। অন্য আরব দেশগুলোও সবুজায়নের জন্য বড়ো বড়ো প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, যা আরব বিশ্বকে তার আগের সবুজ শ্যামল রূপে শিগগিরই ফিরিয়ে আনবে বলে ধারণা করা যায়।
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আরবে দিন দিন শীত বাড়ছে। এমনকি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে সম্প্রতি তুষারপাত হতেও দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পরিমাণও বাড়ছে। এসব কারণে আরবের মরুভূমিতে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। চাষাবাদ আগের তুলনায় অনেক বেশি হচ্ছে। তবে পুরো আরব ভূখণ্ডে সবুজ তৃণলতা ও নদী-নালা এখনও সৃষ্টি হয়নি, যার কথা প্রথম ও দ্বিতীয় হাদিসে বলা হয়েছে। তবে তৃতীয় হাদিসে তাবুকের যে স্থানের কথা বলা হয়েছে, তা আজ বাস্তব। তাবুকজুড়েই এখন বিভিন্ন ফল-ফলাদির বাগান, যা মহানবি স.-এর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (নিহায়াতুল আলম)
তবে মক্কার শুকনো পাহাড় ও মরুর বুকে সবুজ ঘাস ও তৃণলতা গজানোর পরপরই কেয়ামত হয়ে যাবে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং এ ঘটনা থেকে শিক্ষা হলো, কেয়ামত কাছে চলে এসেছে। সেদিন আল্লাহর দরবারে নিজের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। তাই তাঁর নির্দেশিত পথেই জীবন পরিচালিত করে সেদিনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই সকলের কর্তব্য। সেদিন ভালো কাজ ছাড়া কোনো কিছুই কারও উপকারে আসবে না।