বান্দরবানের রোয়াংছড়ির দুর্গম অংজাইপাড়ায় জন্ম আমার। ছেলেবেলা থেকেই অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। মা-বাবা জুম চাষি। কিন্তু তারপরও তাঁরা সর্বস্ব দিয়ে পড়িয়েছেন আমাকে।
বাবা না চাইলে হয়তো এলাকার আর দশজনের মতো আমারও পড়াশোনা হতো না।
২০০২ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ, মঙ্গলবার। অংজাইপাড়ার রেজি. বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে সকাল থেকে প্রাথমিকের নতুন বই বিতরণ চলছে।
আমি তখন বন্ধুদের সঙ্গে মার্বেল খেলছিলাম। বাবা এসে বললেন, ‘আজ থেকে তুমি স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে। ’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ করে দিলাম। কারণ স্কুলে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে মার্বেল খেলা হবে না। তার পরও বাবা খুব নরম সুরে বললেন, ‘বাবা নুথোয়াই, আজকে নতুন বই দিচ্ছে। যাও, স্কুল থেকে বই নিয়ে এসো। ’ এর পরও আমি বললাম, ‘না বাবা, পড়াশোনা ভালো লাগে না, আমি পড়ব না। ’ সঙ্গে সঙ্গে পাশে বেড়ার থেকে বেত নিয়ে আমাকে কয়েকটা বাড়ি দিলেন। হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকলাম। ঠিক করলাম, যতই মারুক কোনোভাবেই স্কুলে যাব না। আমার কান্নার শব্দ শুনে মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাবাকে বললেন, ‘এমন করে কি কেউ মারে নিজের ছেলেকে?’ মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলেন। মা খুব সরল মনে বললেন, ‘বাবা, তুমি আজ থেকে স্কুলে যাবে। পড়াশোনা শিখবে। বড় হয়ে তুমিও অনেক বড় অফিসার হবে; লোকে তোমার নাম বলবে। ’ মায়ের এমন আদর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাবার মাইরও ভুলে গেলাম। সেদিন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলেন স্কুলে। স্কুল থেকে ঝকঝকে নতুন বই পেলাম, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হলো। খুব ভালো লাগল। তখন আমাদের স্কুলে উচনু স্যার, রায় বাহাদুর স্যাররা পড়াতেন। উনাদের ভালোবাসা পেয়ে জীবনে প্রথম ক্লাসটা দারুণ উপভোগ করেছি। মা বাইরে বসে জানালা দিয়ে বারবার
সেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিউটে পড়েছি। ১৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাবর্তনও নিয়েছি। মারমা ভাষায় প্রথম ইতিহাস বইও লিখেছি। আজকে সেই দিনটির কথা বারবার মনে পড়ছিল। মা-বাবা দুজনই নিরক্ষর। তার পরও সব সময় লেখাপড়ার ব্যাপারে তাঁরা আমাকে যে শক্তি-সাহস জুগিয়েছেন, তা অনন্য। তাই সন্তান হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি।