উৎসবের মঞ্চে হতাশায় ডুবল বাংলাদেশ

সিডনির মোর পার্কের মেট্রোতে গত দুদিন ধরেই একটা সতর্কবার্তা চোখে পড়ছিল! সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল-বৃহস্পতিবার পাশের সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দুটো ম্যচে। জ্যামে জীবন কিছুটা জেরবার হয়ে যেতে পারে! তাইতো কিছুটা আগেই গ্যালারিমুখী হয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। হাতে বাংলাদেশের পতাকা, গায়ে লাল-সবুজের জার্সি আর গলায় আমার সোনার বাংলা। সিডনি এই দেড়শ বছরের পুরোনো মাঠটি যেন হয়ে ওঠে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিন্তু এমন আবহেও কিছু হলো না। না, সাজঘরে স্বস্তি ফেরার যে স্লোগান ছিল সেটিও বুমেরাং হয়ে ফিরে এলো! উৎসবের যে মঞ্চ তৈরি ছিল সেখানে হতাশায় ডুবল দল!

সেই পুরোনো বাংলাদেশেরই দেখা মিলল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচেই মুদ্রার অন্য পিঠটাও দেখে

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রাইলো রুশোর সেঞ্চুরিতে চড়ল রান পাহাড়ে, ২০ ওভারে ২০৫। তারপর সেই পাহাড়ে ওঠা দূরে থাক, উল্টো চাপাই পড়ে গেল বাংলাদেশ; ১৬.৩ ওভারে তুলতে পারল মোটে ১০১! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পরের ম্যাচ ৩০ অক্টোবর, ব্রিসবেনে। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।

মনে হচ্ছিল বৃষ্টি বেশ ভোগাতে পারে সিডনি। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক তুমুল বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা। তারপর রোদ হাসল। খেলা শুরু হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের পথেও আরও একবার বাধা। তবে বাংলাদেশ মাঠে নামতেই বেড়ে গেল রোদের তেজ। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের তেজ এখন খড়ের গাঁদায় সূচ খোঁজার মতোই ব্যাপার! কিছুই হচ্ছে না, শুধু আসা-যাওয়ার মিছিল!

তবে শুরুটা মন্দ ছিল না। বড় লক্ষ্যের সামনে কাগিসো রাবাদার করা প্রথম ওভারে আসে ১৭ রান। নাজমুল হোসেন শান্ত আর সৌম্য সরকার প্রাণ ফিরিয়ে দেন গ্যালারিতে হাজির দর্শকদের। তারপর সেই একই চেষ্টা। ব্যাটিংটা আর ঠিক করাই হচ্ছে না। সৌম্য চকিত চমক দেখিয়ে বিদায়! নাজমুল হোসেন শান্তও সেই একই পথের পথিক। একই ওভারে বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে ফেরান আনরিক নরকিয়া।

অবশ্য আউটের পেছনে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থটাই আসবে সবার আগে। ক্রস ব্যাটে খেলতে গিয়ে গড়বড় করে বসেন সৌম্য। তার আগে করলেন ৬ বলে ১৫। এরপর শান্ত দারুণ গতির বলে করলেন লাইন মিস। ৯ বলে ৯ রান তুলে বোল্ড শান্ত। তারপর সাকিবও সেই একই পথের পথিক। সেই আনরিক নরকিয়া তুলে নেন বাংলাদেশ অধিনায়কের উইকেট। অবশ্য সাকিব আউট ছিলেন কি না সেটা একটা প্রশ্ন! নরকিয়ার লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়া বলটি শাফল করতে গিয়ে মিস করেন সাকিব। বলে সরাসরি আঘানে হানে প্যাডে। এলবিডব্লিউর আবেদন। আম্পায়ারও তাতে সাড়া দিলেন। যদিও রিভিউ নিতেই পারতেন ৪ বলে ১ রান করে ফেরা সাকিব।

ক্যাপ্টেন ফেরার পর নিয়মিত বাকি উইকেটগুলোও হারিয়েছে বাংলাদেশ। যে উইকেটে প্রতিপক্ষের দুই ব্যাটসম্যান কুইন্টন ডি কক আর রাইলো রুশো রান তোলাকে ‘ছেলের হাতের মোয়া’ বানিয়েছেন, সেখানেই কি-না রীতিমতো উইকেট বিলিয়ে ফিরেছেন আফিফ হোসেন (১), মেহেদী হাসান মিরাজ (১১), মোসাদ্দেক হোসেন (০) আর নুরুল হাসান সোহান (২)। যা একটু লড়লেন লিটন দাস। কিন্তু সেই লড়াইয়ে কী আর হিমালয় টপকানো যায়। ৩১ বলে ৩৪ রান তুলে আউট তিনি। আর বাংলাদেশেরও সর্বনাশ!

এর আগে ব্যাট করতে নেমে অবশ্য শুরুতেই চমকে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আগের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে উড়িয়ে দেওয়া তাসকিন আহমেদ এদিন নিজের ষষ্ঠ বলেই তুলে নেন উইকেট। অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে কট বিহাইন্ড ফাঁদে ফেলেন বাংলাদেশের এই পেসার।

তাসকিনের অফ স্টাম্পের বাইরে পড়া বলে ব্যাট চালিয়ে ছিলেন বাভুমা। আর সেটিই ঠিকঠাক হয়নি। ব্যাটে-বলের খোঁচার, অনায়াস ক্যাচ উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো নুরুল হাসান সোহানের গ্লাভসে। ৬ বলে ২ রান ফেরেন বাভুমা। এরপরের সময়টুকু শুধুই দক্ষিণ আফ্রিকার। এক মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া কোন বোলারকেই পাত্তা দেয়নি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানরা। আরেকটু সরাসরি বলা যায়-বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া রাইলো রুশো দিশেহারা করে ছাড়েন সাকিব আল হাসানদের।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) নিজেকে ফিরে পাওয়া রুশো এতোটাই বেপরায়া ছিলেন যে বোলিংয়ে কৌশল পাল্টেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি সাকিব আল হাসান। আসলে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে দেশটির বোলারদের বেশ ভালই পড়ে নিয়েছেন এই দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটার। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের উইকেটও অবশ্য স্বস্তি দিয়েছে তাকে।

অনেকটা অনায়াসে রান তুলেছেন রান তুলেছেন আরেক প্রান্তে থাকা কুইন্টন ডি ককও। তবে রুশো বড্ড বেশি কষ্টে ফেলেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হাজির হাজারো বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের। ৩০ বলে ফিফটি তুলে নেন। বিস্ফোরক ব্যাটিং! সেই পঞ্চাশের মধ্যে আবার চার ছক্কা ও দুই চার। আর তাতেই প্রথম ১০ ওভারে ১ উইকেটে হারিয়ে প্রোটিয়ারা তুলে ৯১। তারপরের ১০ ওভারে অবশ্য আরেকটু বেশি রান তুলেছে তারা (১১৪ রান)।

বেশ ভুগেছেন দলের সেরা ক্রিকেটার সাকিবও। এমন কী ১ ওভারে ২১ রানও দিয়েছেন তিনি! খেই হারিয়েছেন তিনি যাদের হাতে বল তুলে দিয়েছেন তারাও। শুধু মুস্তাফিজুর রহমান মিতব্যয়ী। ৪ ওভারে দিলেন ২৫ রান। এই সুযোগে কম গেলেন না ডি ককও। ৩৪ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ফিফটি। মাঝে অবশ্য প্রাণ পেলেন রুশো। ক্যাচ ছাড়েন হাসান মাহমুদ। তাসকিন আহমেদের বলে থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়েছিলেন রুশো। কিন্তু সহজ ক্যাচটিও হাতে জমাতে পারেন নি হাসান। তখন রুশোর রান ৮৮।

এক পর্যায়ে ভাঙে রুশো-ডি কক জুটি। রাইলি রুশোর সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ জুটি গড়ে ফিরে যান। তিনি বিদায় নেন ৩৮ বলে তিন ছক্কা ও সাত চারে ৬৩ রান তুলে। তাতেই শেষ হয় ১৬৮ রানের রেকর্ড জুটি। বিশ্বকাপে আগের সর্বোচ্চ জুটি গড়েন মাহেলা জয়াবর্ধানে ও কুমার সাঙ্গাকারা। ২০১০ আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তারা তুলেছিলেন ১৬৬ রান।

মাঝে বৃষ্টি বাগড়া বাধালেও এর আগে পড়ে সাবলীল ছিলেন রুশো। টাইগার বোলারদের দিশেহারা করে তুলে নেন টি-টোয়েন্টিতে নিজের টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। এবার ৫২ বলে ৭টি করে ছক্কা-চারে তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগার! এটিই চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম শতরান। ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটি ছিল আরও আক্রমণাত্মক। সেবার রুশো ৪৮ বলে তুলেন সেঞ্চুরি। এবার ৫৬ বলে আট চার ও সাত চারে ১০৯ রান তুলে সাকিবের শিকার হন তিনি।

তার পথ ধরে টিম সাউদির শ্রেষ্ঠত্বে ভাগ বসান সাকিব। ১২৫ উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শিকার এই দুজনের! তবে নিজের এই অর্জনেও হাসিমুখ থাকার সুযোগ কোথায়? ৩ ওভারে দিলেন ৩৩। সবচেয়ে খরুচে আগের ম্যাচের জয়ের নায়ক তাসকিন, ৩ ওভারে ৪৬ রানে ১ উইকেট!

আসলে এমন এলোমেলো বোলিংয়েই সর্বনাশ! সাকিব কথা দিয়েছিলেন সিডনির বাংলাদেশি দর্শকদের ভালবাসার প্রতিদান দেবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও হাসিমুখে ছুটে এসেছিলেন মাঠে। গলা ছেড়ে চিৎকারও করেছেন। উড়িয়েছেন অহঙ্কারের লাল-সবুজ! কিন্তু বাংলাদেশ দল জাগল কোথায়? ১৭৪ বছরের পুরোনো মাঠে নিজেদের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা খেলতে নেমেই সেই পুরোনো কঙ্কালটা বেরিয়ে আসল বাংলাদেশ ক্রিকেটের! ২০ ওভারের ক্রিকেটে এখনো সেই নখদন্তহীন বাঘই রয়ে গেল দল!