মাথায় গুরুতর আঘাতের কারণেই মাশা আমিনির (২২) মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। মাশা আমিনির খালাত ভাই ইরফান সালিহ মোর্তেজাঈ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জনিয়েছেন।
এএফপিকে তিনি বলেন, ‘মাশা যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল, সেখানকার ডাক্তারদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, ভারি লাঠি বা এই জাতীয় কোনো বস্তু দিয়ে তার মাথায় ব্যাপক জোরে আঘাত করা হয়েছিল এবং তার মৃত্যুর কারণও সেই আঘাত।’
মোর্তেজাঈ জানান, মাশার পরিবার তেহরানে থাকলেও তিনি গত কয়েক বছর ধরে কুর্দিস্তানে তার খালার বাড়িতে ছিলেন। সেখানেই পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা তার।
মোর্তেজাঈ আরও জানান, জাতিগতভাবে তারা কুর্দ এবং তিনি নিজে কোমালা নামের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উচ্চ পর্যায়ের সদস্য, যারা স্বাধীন কুর্দিস্তানের দাবিতে আন্দোলন করছে। বর্তমান কুর্দিস্তানের কিছু অংশ ইরান এবং কিছু অংশ ইরাকে পড়েছে।
কুর্দিস্তানে এএফপিকে যখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন মোর্তেজাঈ, সেসময়ও তার গায়ে ছিল সামরিক পোষাক। তবে মাশা কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কখনও যুক্ত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তার খালাত ভাই।
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তেহরানে মাশা ও তার ভাই কিয়ারেশের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও মৃত্যুর আদ্যোপান্ত বিবরণ দেন মোর্তেজাঈ।
তিনি বলেন, ‘মাশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। ক্লাস শুরু হতে আরও কিছুদিন বাকি ছিল। এই সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে তেহরান গিয়েছিল সে।’
‘মাশা বোরকায় অভ্যস্ত ছিল না, আমরাও তাকে এই নিয়ে কখনও কিছু বলিনি। গত ৯ সেপ্টেম্বর মাশা আর তার ভাই কিয়ারেশ (১৭) ঘুরতে বের হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সে বোরাকা পরেনি, তার মাথায় স্কার্ফ ছিল, কিন্তু সেটি ছিল শিথিলভাবে বাঁধা।’
‘এ সময় হঠাৎ নৈতিকতা পুলিশ মাশা ও কিয়ারেশকে থামায় এবং আটক করে। কিয়ারেশ পুলিশের কাছে অনুনয় করে বলেছিল যে মাশা তেহরানে নতুন এবং সে এখানকার স্থানীয় রীতি নীতি জানে না, কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তার অনুরোধে কর্ণপাত করেনি।’
‘উল্টো কিয়ারেশকে এক পুলিশ কর্মকর্তা তখন বলে— আমরা তাকে নিয়ে যাচ্ছি; কীভাবে পোষাক পরতে হয়, হিজাব বাঁধতে হয়— তা ধীরে ধীরে তাকে শেখানো হবে।’
‘কিয়ারেশের সামনেই তারা মাশাকে চড়-থাপ্পড় মেরেছে, হাতে ও পায়ে লাঠির আঘাত করেছে। কিয়ারেশ বাধা দিতে গেলে তার চোখে পিপার স্প্রে ছড়িয়েছে; এবং তারপর দু’জনকে ভ্যানে তুলেছে।’
‘ভ্যানে তোলার পরও তাকে আঘাত করছিল পুলিশ সদস্যরা। এ সময় এক পুলিশ সদস্য ব্যাটন দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে, এবং তারপরই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। ওই অবস্থাতেই থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।’
এএফপিকে মোর্তেজাঈ বলেন, ‘যদি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো, তাহলেও হয়তো আমার বোন বেঁচে যেতো। কিন্তু থানায় নিয়ে যাওয়ার পরও অজ্ঞান অবস্থায় আধাঘণ্টারও বেশি সময় রাখা হয় তাকে। কারণ ওই পুলিশদের সন্দেহ ছিল— মাশা হয়তো অভিনয় করছে।’
গত ১৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মাশা। তার মৃত্যুর পর ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ইরান এবং সেখানকার প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও সরকারের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ শুরু হয়েছে দেশটিতে। টানাম ১২ দিন ধরে ইরানের ছোট বড় প্রতিটি শহরে বিক্ষোভ করছেন সরকারবিরোধীরা
ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী শাসকগোষ্ঠী অবশ্য বিক্ষোভ দমনে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। গত ১২ দিনে দেশটির পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৭৬ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে সেই সঙ্গে বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ হাজার ২০০’রও বেশি আন্দোলনকারীকে।
কিন্তু তারপরও থামানো যাচ্ছে না এই ব্যাপক গণবিক্ষোভ।
এই বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়ে এএফপিকে মোর্তেজাঈ বলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রপন্থী ভাই-বোনেরা যে আন্দোলন করছে, তাকে আমরা দ্ব্যার্থহীনভাবে সমর্থন করছি। কারণ, আমরা তরুণরা জানি— ভবিষ্যতে আমাদের জন্য একটি সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে এবং একমাত্র এই নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করার মাধ্যমেই সেই জীবন আমরা লাভ করতে পারি।’