পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কিছু অডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) সহ-সভাপতি মরিয়ম নওয়াজ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মুসলিম লীগের (নওয়াজ) সদস্যদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার বা মুসলিম লীগের (নওয়াজ) পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে নীরবতার কারণে এসব অডিও টেপ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে, যার মূল বিষয় হচ্ছে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের সাইবার নিরাপত্তা।
অবশ্য সরকারের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়ার আগেই পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।
ফাঁস হওয়া অডিওতে কথোপকথনটি বিতর্কের বিষয় হলেও, এটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে এ কথোপকথন রেকর্ড করল কে? আর এটা অনলাইনে এলোই বা কিভাবে? পাকিস্তানের সাইবার নিরাপত্তা কতটা শক্তিশালী তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
অতীতেও পাকিস্তানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে, তবে এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ফোন কথোপকথন।
ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, জাতীয় সংসদের স্পিকার সর্দার আয়াজ সাদিক, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী আজম নাজির এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবালের কণ্ঠস্বর রয়েছে।
এতে পিটিআইয়ের পদত্যাগের বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
পিটিআই নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী ওই অডিও শেয়ার করে প্রশ্ন তুলেছেন, ডার্ক ওয়েবে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের অফিসের তথ্য বিক্রির জন্য পেশ করা হয়েছে, এরমধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের সাইবার নিরাপত্তার পরিস্থিতি কী তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। এটা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে আইবির বড় ব্যর্থতা। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও নিরাপত্তা ও বিদেশ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখন সবার হাতে।
ফাওয়াদ চৌধুরীর দাবি কীসের ভিত্তিতে তা বলা কঠিন, তবে টুইটারে @OSINT_Insider (ওপেন সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স ইনসাইডার) অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এই অডিওগুলো ১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রেকর্ড করা তথ্যের অংশ, ডার্ক ওয়েব হ্যাকিং ফোরামে ৩০ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি দাম উঠেছিল এর।
ওপেন সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স ইনসাইডার দাবি করেছে যে এটি কোনো ফোন কথোপকথন নয়, এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রেকর্ড করা একটি কথোপকথন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে কখন, কীভাবে এবং কোথায় এটা রেকর্ড করা হয়েছিল? বেশিরভাগ মানুষই জানতে চাচ্ছেন যে এটি আসলেই নিরাপত্তার ত্রুটি কিনা এবং যদি তাই হয়, তাহলে এই নিরাপত্তা ত্রুটি কতটা বড় এবং এর জন্য কে দায়ী?
খাইবার পাখতুনখোয়ার অর্থমন্ত্রী তৈমুর ঝাগদাও একই রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শওকত তারিনের সঙ্গে তার একটি কথোপকথেনর অডিও কিছুদিন আগে ফাঁস হয়েছিল।
শওকত তারিন প্রশ্ন করেন, কোন আইনের আওতায় এবং কখন, কে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথোপকথনটি ট্যাপ করছে, পিএমওতে বা ফোনে, কেউ কি উত্তর দেবে? এবং এই তথ্য রক্ষার দায়িত্ব কার?
পাঞ্জাবের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ড. আরসালান খালিদ বলেছেন, আসল প্রশ্ন হলো, ১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রেকর্ডিং কীভাবে হলো? প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কি গোয়েন্দা যন্ত্র বসানো হয়েছিল?
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘরে পররাষ্ট্রনীতিসহ সব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে কি এই সব তথ্যও হ্যাকারদের কাছে আছে? এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা পাকিস্তানের ওপর সাইবার হামলা।
উমর সাইফ, যিনি পূর্ববর্তী শেহবাজ শরিফ সরকারের সময় পাঞ্জাবে ডিজিটাল সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন, তিনি বলছেন যে, পাকিস্তানের সাইবার স্পেস নিরাপদ নয়।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাইবারস্পেসের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই। তিনি বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। পাকিস্তানকে রাজনৈতিক উত্তেজনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং বুঝতে হবে হুমকি আসলে কী।
একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি কথোপকথনটি রেকর্ড করেছে, নাকি তারা এ বিষয়ে অবগত ছিল না?
সাংবাদিক আসিমা শিরাজি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনও যখন নিরাপদ নয়, তখন বাকিদের কী বলার আছে। জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ সালের উপন্যাসের চরিত্র ‘বিগ ব্রাদার’-এর কথা মনে পড়ে গেল, যে সব কিছুর ওপর নজর রাখে। এখানে বড় ভাই কে?
সাংবাদিক মুবাশির জাইদি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মরিয়ম নওয়াজের উচিত অডিও ফাঁসের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানানো। যদি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটে, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ারম্যান এতদিনে পদত্যাগ করতেন।
এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা না আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এই অডিও যদি ভুয়া না হয়, তাহলে এটা রেকর্ড করা হলো কিভাবে?
আজিজ ইউনুস নামে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী লিখেছেন, প্রথম পরিস্থিতি হলো, সেখানে উপস্থিত কারও ফোন হ্যাক করা হয়েছে, যেখানে লোকেশনের সাহায্যে ফোনের মালিকের সম্মতি ছাড়াই ফোনে থাকা হট মাইক ব্যবহার করা হয়েছে।
আজিজ ইউনূসের মতে, এমনও হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকা গোয়েন্দা যন্ত্রের সাহায্যে এই কথোপকথনটি রেকর্ড করা হয়েছিল এবং পরে তা ফাঁস করা হয়।
সাংবাদিক সিরিল আলমাইদা লিখেছেন, ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমি প্রথম একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম যে, একজন লোক এসে মেশিনের সাহায্যে দু’বার ঘরে তল্লাশি চালায় এবং সমস্ত ডিজিটাল গ্যাজেট দূরে সরিয়ে রাখা হয়।