সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। সে দলে খেলেছেন কলসিন্দুরের আট জন৷
তারা হলেন সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, তহুরা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার ও শিউলি আজিম৷
তাদের সবারই ফুটবলে হাতেখড়ি কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের মাধ্যমে৷ যদিও বর্তমানে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রণসিংহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে৷
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসার সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের গল্প বলেছেন মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন৷
কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মফিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের এই মেয়েরা অনেক কিছুই উপহার দিয়েছে৷ সেই সব উপহার ছিল বয়সভিত্তিক দলে৷ এই প্রথম বাংলাদেশ নারী জাতীয় দল সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে৷ এটা অবশ্যই গর্বের ও আনন্দের৷ এই দলে আমার হাতে গড়া আটজন ফুটবলার আছে৷ এজন্য আমার গর্বটা আরও বেশি৷ আনন্দটাও একটু বেশি৷
মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসার শুরুটা কীভাবে করছিলেন, এমন প্রশ্নে এই শিক্ষক বলেন, আমি একেবারে শুরুর কথা বলি৷ ২০১০ সালে ছেলেদের স্কুল ফুটবলের ফাইনালে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পরের বছর থেকে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হবে৷ ওই সময় আমার মাথায় আসে যে, মেয়েদের নিয়ে ফুটবল টিম করব৷ আমি তখন কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক৷ মেয়েদের এক ক্লাসের সঙ্গে আরেক ক্লাস, এক সেকশনের সঙ্গে আরেক সেকশনের ফুটবল খেলার মাধ্যমে বেশ কিছু খেলোয়াড় বাছাই করি৷ তো প্রথম অবস্থায় এই এলাকার পরিবেশ, লোকজনের চালচালন কিংবা ধর্মীয় বোধ, সেটি একেবারে
সহযোগিতা করছিল না৷ নানা বাধা-বিপত্তি ছিল৷ মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে খেলছে কেন, এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে সালোয়ার-কামিজ পরে খেলতে হতো৷ মেয়েদের আবার কীসের ফুটবল খেলা-এমন কথাও ছিল৷ এসব অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমরা খেলাটা শুরু করেছিলাম৷
মেয়েদের পরিবারকে কীভাবে বুঝিয়েছেন, এমন প্রশ্নে মফিজ উদ্দিন বলেন, অনেক কিছুই বলতে বলতে হয়েছে৷ যেমন, বাংলাদেশের নারীরা আর আগের মতো পিছিয়ে নেই৷ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেয়েদের ফুটবলের উদাহরণ দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করেছি৷
সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী দলের খেলোয়াড় সানজিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্কুলের মেয়েদের মধ্য থেকে বাছাই করেছিলাম৷ সেখানে সানজিদা টিকেছিল৷ মেয়ের ফুটবল খেলার ব্যাপারে ওর মায়ের একটু আপত্তি ছিল৷ ওর দুলাভাইয়েরও আপত্তি ছিল৷ তবে বাবার সহযোগিতার কারণে সানজিদা ফুটবলে আগ্রহী হয়েছে৷ সানজিদার বাবা কৃষক৷ মা গৃহিনী৷
সাফ ফাইনালে প্রথম গোল করা শামসুন্নাহার জুনিয়র প্রসঙ্গে মফিজ উদ্দিন বলেন, আমরা যখন খেলা শুরু করি, তখন শামসুন্নাহার একেবারে ছোট৷ ওকে অনেকে পিচ্চি শামসু বলত৷ সানজিদাদের ১৭ দলের দলে ও থাকত, তবে শুরুর একাদশে না৷ খেলার শেষ দিকে মাঠে নামাতাম৷ দেখা যেত, ওই চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে একটা ঝলক দেখাত৷ মানুষকে আনন্দ দিত৷ একবার মনে আছে, ওই শেষ চার-পাঁচ মিনিট খেলেই ও ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে যায়৷
কলসিন্দুরের আরেক ফুটবলার তহুরা খাতুনের ফুটবলে আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তহুরার বিষয়টা আরও কঠিন ছিল৷ ওর দাদা একজন হাজী৷ ওনাকে আমিও দাদা ডাকি৷ আমাকে এক দিন বললেন, ‘তুই যে আমার নাতিরে খেলা শিখাইতাছোস, ওরে বিয়া দেওন লাগব না! বল খেললে ওরে বিয়া দেওন যাইব?’ এ নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে৷ তহুরার দাদা ফুটবল খেলতে নিষেধ করে দেয়৷ ওর বাবাও নিষেধ করে৷ তহুরার দুলাভাই একজন হাফেজ এবং মওলানা৷ তহুরা ফুটবল খেললে খুব রাগ করতেন৷ এ কারণে তিনি এলে তহুরা আর বাড়িতে থাকত না৷ এরপর আমি এলাকার মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তহুরার বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি৷ শুধু ওর কাকারা রাজি ছিল মেয়েকে খেলতে দিতে৷ আর মেয়ের
যেহেতু এত আগ্রহ, তাই সবাই মিলে বোঝানোর পর তহুরার বাসা থেকে ফুটবল খেলতে দিতে রাজি হয়েছে৷ এখন তো মেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে৷ সবাই তাই ক্রেডিট নিতে চায়৷
তবে মারিয়া মান্দার পরিবারের কোনো বাধা ছিল না জানিয়ে মফিজ উদ্দিন বলেন, মারিয়া মান্দার পরিবারের দিক থেকে কোনো বাধা ছিল না৷ ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল দারিদ্র্য৷ এমনও হয়েছে যে, ওর বুট কেনার টাকা নেই৷ অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে ওই টাকা দিয়ে মারিয়া মান্দা বুট কিনেছে-এমন ঘটনাও আছে৷ আমাকে বলেছে, স্যার আমি দুদিন খেলায় আসতে পারব না৷ আমি ওকে ছুটি দিয়েছি৷ পরে জানতে পেরেছি, ওই দুদিন মারিয়া অন্যের জমিতে কাজ করে সে টাকা দিয়ে বুট কিনেছে৷ ওর মা-ও অন্যের জমিতে কাজ করত৷ এরকমও দিন গেছে ওদের৷
তিনি আরও বলেন, ওরা তো আদিবাসী৷ ওদের সমাজে মেয়েকে খেলতে দেবার ব্যাপারে বিধিনিষেধ নেই৷
নারী ফুটবলারদের পরিবারের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে মফিজ উদ্দিন বলেন, ভালো৷ তবে কলসিন্দুরের যে মেয়েদের কথা বললেন, ওদের মধ্যে সানজিদা ও তহুরা ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা৷ আমি যখন কলসিন্দুর স্কুল থেকে বদলি হয়ে যাই, তখন ৭০-৮০ জন মেয়েকে নিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস করাতাম৷ তাদের প্রায় সবাই গরিব৷ এখন যারা জাতীয় পর্যায়ে খেলছে, ওদের আর আগের মতো দরিদ্রতা নেই৷ মোটামুটি চলার মতো সংস্থান হয়েছে৷
দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন এই মেয়েদের নিয়ে আরও কত বড় স্বপ্ন দেখেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে স্বপ্ন তো দেখাই যায়৷ কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা বড় কথা৷ আমাদের আর্থ-সামাজিক যে অবস্থা, আমাদের মেয়েদের যে শারীরিক গঠন, শক্তিমত্তা-এসব বিবেচনা করলে এত বেশি উচ্ছ্বসিত হওয়া যায় না৷ তারপরও আমি আশা রাখি, যে গ্রুপটা এখন আছে আর পাইপলাইনে যে মেয়েরা আছে, তাদের নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে না পারলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজত্বটা যেন আরও কিছু দিন থাকে৷