লাস ভেগাসে ‘বঙ্গ সম্মেলনজুড়ে’ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিনদিনব্যাপী ‘বঙ্গ সম্মেলন’। ভারতীয় বাঙালিদের সংগঠন কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল-সিএবি আয়োজিত নর্থ আমেরিকার বেঙ্গলি কনফারেন্স বা উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলনের ৪২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশিরা এবার অংশ নিয়েছেন। এ বছর বঙ্গ সম্মেলন জুড়েই ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব বঙ্গ সম্মেলন। বরাবরই কিছু সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি এতে যোগ দেন। তবে এবার সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি অংশ নিয়েছেন। এবারই প্রথম বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর একটি গীতি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে।

সাংবাদিক হাসানুজ্জামান সাকীর গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় এবং অ্যানি ফেরদৌসের নৃত্য নির্দেশনায় ‘জয় বাংলা’ গীতি নৃত্য নাট্যে পারফর্ম করেন নিউইয়র্কের বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পীরা।

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘জয় বাংলা’ গীতি নৃত্য নাট্য। ধারা বর্ণনা করেন খাইরুল ইসলাম পাখি ও সাদিয়া খন্দকার।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, অনেক বছর ধরে বঙ্গ সম্মেলনে আসি, কিন্তু এবার যেভাবে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হয়েছে তা ছিল সত্যি অতুলনীয়। বিদেশের মাটিতে ‘জয় বাংলা’ গীতি নৃত্যনাট্য দেখে আমি আমি আপ্লুত। আমি হাসানুজ্জামান সাকীকে ধন্যবাদ দিতে চাই এমন সুন্দর একটি পরিকল্পনা করার জন্য।

বন্যা বলেন, আমরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের তেজোদীপ্ত ইতিহাস দেখলাম, এবং সেই অগ্রযাত্রা এখনও বহমান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যেভাবে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন, আমরা তার পূর্ণতা পেতে শুরু করেছি। তার সমস্ত ইঙ্গিত আমাদের সামনে দৃশ্যমান। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন এখন উন্নত দেশের তার সেই স্বপ্নকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাস্তবে রূপান্তরিত করবেন।

সিলেটে জন্ম নেওয়া বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কেপিসি গ্রুপের চেয়ারম্যান কালী প্রদীপ চৌধুরী বলেন, দুই বাংলার বাঙালিদের এমন মিলন মেলা ঐতিহাসিক। দুই বাংলা যখন এক হয়, তখন সবকিছুর জয় হয়। তিনি বলেন, আমার মন আজ আনন্দে ভরে উঠছে এমন একটি সুন্দর অনুষ্ঠান দেখে। আমরা বাঙালির এই বন্ধনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

বঙ্গ সম্মেলনের ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের ছবি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ফিল্ম ফেস্টিভাল।

এতে যৌথভাবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে রিকশা গার্ল ও রাতজাগা ফুল। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা মীর সাব্বির ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হয়েছেন আশনা হাবিব ভাবনা। শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ফেস্টিভালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর নির্মিত অনন্য মামুনের ছবি ‘রেডিও’ বিশেষ জুরি পুরস্কার জিতেছে। ভারতীয় বাংলা ছবির জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা ছবির প্রযোজক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এছাড়া চিত্রনায়ক ইমনকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত চিত্রনির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, টলিউডের অভিনয়শিল্পী শ্বাশত চট্ট্যোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী ও ভারতীয় গায়িকা ইমন চক্রবর্তী।

এছাড়া পুরস্কারের মঞ্চে ছিলেন আলোকচিত্রশিল্পী মুনিরা মোরশেদ মুন্নি, ড. সেজান মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী তৃষ্ণা মাহমুদ ও সালমা রোজী, লস অ্যাঞ্জেলেস লিটল বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি মশহুরুল হুদা ও সাধারণ সম্পাদক লষ্কর আল মামুন।

এর আগে ফিচার ফিল্ম ফেস্টিভালে পৃথক দুটি হলে দুই বাংলার ছবি প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশের যেসব ছবি প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলো হলো রিকশা গার্ল, রাতজাগা ফুল, রেডিও, অনন্য মামুন পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র জাহানারা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণ নির্মাতা সারোয়ার হাবিব পরিচালিত ‘দি লাস্ট সিন’। প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে দর্শকের ছিল উপচে পড়া ভিড়।

ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে দুই বাংলার অভিনয় শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন মাজিদ ডিজায়ারের শিল্পীরা।

শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে বাংলাদেশের নির্মাতা অনন্য মামুন পরিচালিত ‘জাহানারা’ বিশেষ পুরস্কার পায়। ছবিটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা সাজিয়া হক মিমি পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।

বঙ্গ সম্মেলনের সাহিত্য উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক ছাড়াও অংশ নেন প্রবাসী বাংলাদেশি সাহিত্যিকরা। সাহিত্য সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে নিজেদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ পাঠ করেন ড. সেজান মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, বেনজির শিকদার প্রমুখ।

বঙ্গ সম্মেলনের শেষ দিনে টলিউডের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিয়ম করেন। তিনি বলেন, বহু বছর ধরে বঙ্গ সম্মেলনে আসি। দুই বাংলার মানুষকে এক সাথে দেখে খুব ভাল লাগে। কিন্তু এবার বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ দেখে আমি অভিভূত। তাই নিজের ইচ্ছায় আপনাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ চাইলাম।

বাংলাদেশ পারফর্মিং আর্টস বিপার অন্যতম কর্ণধার অ্যানি ফেরদৌস বলেন, অনেক বছর ধরে বঙ্গ সম্মেলনে আসি। কিন্তু এবারই প্রথম এত বড় আয়োজনে মূল মঞ্চে আমরা বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে পারফর্ম করলাম। তিনি বলেন, জয় বাংলা গীতি নৃত্য নাট্যে যেভাবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে তা দেখে দর্শকরা ভীষণভাবে আপ্লুত হয়েছেন, তারা আবেগে কেঁদেছেন। আমাদের এমন সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বঙ্গ সম্মেলন কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আমি আঠাশ বছর মানুষের হাতে বাংলা বই তুলে দেওয়ার জন্য বঙ্গ সম্মেলনে আসি। এরআগে কখনও এত বাংলাদেশির অংশগ্রহণ দেখিনি। এবার এমন কিছু বাংলাদেশি এসেছেন যারা বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সুপরিচিত। তারাও প্রথমবারের মতো বঙ্গ সম্মেলনে এসেছেন।

বঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন এ বছর শিকাগো ও লস অ্যাঞ্জেলেস-এ অনুষ্ঠিতব্য দুই ফোবানার শীর্ষ নেতৃত্ব, বাংলাদেশের আলোকচিত্রী রূপম চৌধুরী, তাপস বড়ুয়া, জাহেদ শরীফ, শাহ জুলফিকার, মাজিদ ডিজায়ারের নৃত্যশিল্পী মাজিদ লোদী, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রবাসী শেখ সেলিম ও সাঈদা লতা, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ ক্লাবের পক্ষে মো. আবদুল হামিদ, শিবলী ছাদিক, সেলিনা তুহিন, সোনিয়া সুলতানা, হুমায়ূন কবীর, রোজি আজাদ প্রমুখ।

তিন দিনের বঙ্গ সম্মেলনে সংগীত পরিবেশন করেন বলিউডের জনপ্রিয় গায়ক জুটি সালিম-সোলাইমান, বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, কলতাকার ইমন চক্রবর্তী, লগ্নজিতা চক্রবর্তী, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন গাঙ্গুলি, পৌষালী ব্যানার্জি, শ্রেয়া গুহঠাকুরতা. তীর্থ ভট্টাচার্য, শালিনী মুখার্জি, ত্রিজয় দে, মেখলা দাসগুপ্ত প্রমুখ।