একেক সময় একেক কথা মালয়েশীয় মন্ত্রীর

কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে মালয়েশিয়া যে বক্তব্য দিচ্ছে, তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। আমাদের সময়কে তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কখনই ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমোদন দেয়নি।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ান মানবসম্পদমন্ত্রী দাতো শ্রী এম. সারাভানান দাবি করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছেন।

এম. সারাভানানের বরাত দিয়ে গতকাল মালয়েশিয়ার গণমাধ্যম ‘মালয় মেইলে’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমোদনের বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। সারাভানান বলেন, মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়টি এজেন্সি অনুমোদন পাবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে নিয়োগকারী দেশ। মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে এজেন্সির সংখ্যা ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫টি করেছে।

সারাভানান বলেন, ‘আমি যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি, তিনি ২৫ এজেন্সির বিষয়ে একমত ছিলেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীও ২৫ এজেন্সিতে একমত ছিলেন। তা হলে আমাদের মালয়েশিয়ার এমপিরা এখন কেন দ্বিমত করছেন?’

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘২৫ রিক্রটিং এজেন্সির বিষয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময়ও এ বিষয়ে কথা হয়নি। তিনি কীভাবে বলেন যে আমরা ২৫ এজেন্সিকে অনুমোদন করেছি? এ ছাড়া মালয়েশিয়ানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ থেকে গেলেন, তখনো তিনি বলেছেন, এটা রিসিভিং কান্ট্রির বিষয়। বিষয়টি মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। তা হলে তিনি কীভাবে এসব কথা বলেন?’

ইমরান আহমদ বলেন, ‘সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির কথা উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ওই দিনের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকেও ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারণ হয়নি।’

এদিকে গত ২ জুন ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কতগুলো রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করবে, তা নিয়োগদাতা দেশ নির্ধারণ করবে।’ বিষয়টি মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি।

সারাভানান আরও জানান, শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে। তিনি বলেন, ‘জিরো মাইগ্রেশন কস্ট’ কোনো নিয়োগকর্তা বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির কোটা বাতিল করা হবে বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি।

পরে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেন, ‘সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বা আজকের বৈঠকে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির কথা উল্লেখ নেই। অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬০ হাজারের নিচে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এমওইউ অনুযায়ী আমরা ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছি। সেখান থেকে তারা বাছাই করে দেবে, কতগুলো এজেন্সি কাজ করবে। তবে এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কারণ কর্মী নেবে তারা। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’

ইমরান আহমদ, ‘মালয়েশিয়ার বাজার খুলছে। চলতি জুন মাস থেকেই কর্মী যাওয়া শুরু হবে। এক বছরে দুই লাখ কর্মী নেবে মালয়েশিয়া। এ জন্য শিগগিরই কর্মী যাওয়ার খরচ নির্ধারণ করে দেবে মন্ত্রণালয়।’

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে আর কোনো বৈঠকের হয়তো প্রয়োজন হবে না। সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী সব শর্ত মেনেই দেশটিতে কর্মী পাঠানো হবে।’

কোন প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানো হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে সরকারিভাবে বৈধ ১ হাজার ৫২০টি এজেন্সি রয়েছে। তাদের তালিকা আমরা আগেই পাঠিয়েছি। সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী এ তালিকা থেকে বাছাইয়ের অধিকার মালয়েশিয়ার রয়েছে।’

বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর জন্য দেশে ১ হাজার ৫২০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের লাইসেন্স দিয়েছে। এসব লাইসেন্সের বিপরীতে লাখ লাখ টাকা জামানত নিয়েছে সরকার। তাদের মনিটরিং করা, আইন প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। অথচ কিসের ভিত্তিতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বাছাই করবে মালয়েশিয়া- এমন প্রশ্ন খাত সংশ্লিষ্টদের।

তারা বলছেন, মালয়েশিয়া কীভাবে, ক্রাইটেরিয়া ফিক্স ও সিলেকশন করবে? এটা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের। এটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। মালয়েশিয়া সরকার কোন ক্রাইটেরিয়ার অবলম্বন করেছে? তারা কি এ দেশের সরকারের কাছ থেকে যোগ্য এজেন্সির জন্য কোনো তথ্য অফিসিয়ালি নিয়েছে? তারা কি এসব এজেন্সির রেকর্ড চেক করেছে, এজেন্সির মালিক কে, বাকগ্রউন্ড কী, তাদের অফিস কেমন, ফ্যাসিলিটি আছে কিনা, পূর্বে বৃহৎ পরিসরে কর্মী প্রেরণের অভিজ্ঞতা আছে কিনা, কিসের ভিত্তিতে তারা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে?

গমঝোতা স্মারকে ২৫ লাইসেন্সের কোনো কথা উল্লেখ নেই। লাইসেন্স নিয়ে বৈষম্য করা যাবে না। বাংলাদেশের সব লাইসেন্সের স্ট্যাটাস একই।

জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, ‘সরকার কীভাবে জেনেশুনে সমঝোতা স্মারকে মালয়েশিয়া সরকারকে এজেন্সি সিলেক্ট করার অধিকার দিল। যেখানে এজেন্সির পারফরম্যান্স সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য আছে বিএমইটিতে। নাম ছাড়া মালয়েশিয়া সরকারের কাছে কিছুই নেই। তা হলে কিসের ভিত্তিতে ২৫ এজেন্সি সিলেক্ট হলো? ২৫ এজেন্সির তালিকায় যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, বেশিরভাগেরই কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনও এজন্সি আছে, যারা একজন কর্মীয় পাঠায়নি। বাংলাদেশ সরকার ত্রুটিপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে অনেক বড় ভুল করেছে।

এদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠাতে গত ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক সই করে দুই দেশ। এর পর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী সারাভানান জানান, প্রধান ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিটির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে আরও ১০টি এজেন্সি কাজ করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ‘মূল’ বা ‘সহযোগী’ বলে কিছু নেই।

এ চিঠির আপত্তি জানিয়ে ১৮ জনুয়ারি পাল্টা চিঠি দেন মন্ত্রী ইমরান আহমদ। ওই চিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) সার্টিফিকেট এবং বাংলাদেশ কম্পিটিশন অ্যাক্ট, ২০১২-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার সীমিত সংখ্যক এজেন্সিকে কাজ দিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বৈধ লাইসেন্সধারী সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সমান সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের স্বচ্ছ, অনিয়মমুক্ত ও নিরাপদ অভিবাসন চায়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ড. তাসনীম সিদ্দিকী আমাদের সময়কে বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটাই অন্যায়। অন্যায়েরই জয় হচ্ছে। কতিপয় ব্যক্তিকে অর্থশালী করার সুযোগ তৈরি করেছে অসাধু প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। মালয়েশিয়ায় কাউকে অপব্যবহার করে এমন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ বছর মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোরই প্রয়োজন নেই। কারণ এ বছর বিভিন্ন দেশে ১০ লাখের বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে। সুতরাং অন্যায়ের কাছে মাথানত করে অভিবাসনের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ যদি কর্মী না পাঠায়, তাতেও সমস্যা নেই। কারণ মালয়েশিয়া ঠিকই দুমাসের মাথায় বাংলাদেশের শর্ত অনুযায়ী কর্মী নিত।’

তিনি বলেন, ‘সুশীল সমাজ শুরু থেকেই দাবি করে আসছে এমন একটি অন্যায়ের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর দরকার নেই। পুরো প্রক্রিয়াই এক অর্থে অবৈধ। যেখানে বৈধ লাইসেন্সধারী ১৫০০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে পাশ কাটিয়ে মাত্র ২৫টি লাইসেন্স কাজ করবে, এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। যা কিছু হচ্ছে তা ব্যক্তি স্বার্থেই হচ্ছে।’