মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ভারত এক কূটনৈতিক ঝড়ের মধ্যে পড়েছে। প্রায় দশ দিন আগে এক টিভি বিতর্কে করা নূপুর শর্মার মন্তব্য ভারতীয় মুসলমানদের পাশাপাশি বেশ কিছু ইসলামপ্রধান দেশের সরকার ও জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিজেপি নুপূর শর্মাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। দলের দিল্লি মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নবীন কুমার জিন্দালকেও টুইটে তার আপত্তিকর মন্তব্যের স্ক্রিনশট শেয়ার করার জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিজেপি বলেছে, তারা কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে অবমাননা বা অবজ্ঞা করে এমন মতাদর্শের বিরুদ্ধে। ক্ষুব্ধ ইসলামি দেশগুলোকে শান্ত করার প্রয়াসে ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ওই মন্তব্য ভারত সরকারের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না এবং সেগুলো দলের ‘প্রান্তিক পাত্রপাত্রীদের মতামত’। কিন্তু অনেকেই যেমনটা উল্লেখ করেছেন, নুপূর শর্মা আসলে কোনো ‘প্রান্তিক’ চরিত্র নন। পদচ্যুত করার আগ পর্যন্ত ৩৭ বছর বয়সী এই আইনজীবী ছিলেন ‘বিজেপির দাপ্তরিক মুখপাত্র। ’ তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রতিনিধিত্ব তথা তাদের সমর্থনের জন্য রাতের পর রাত টিভির টক শোতে হাজির হয়ে এসেছেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রী নুপূর শর্মা ২০০৮ সালে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। সেবছরই হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) প্রার্থী হিসাবে ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা আইনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০১১ সালে ভারতে ফিরে আসার পর তার রাজনৈতিক জীবনের গতি বেড়ে যায়। বেপরোয়া ধরনের সাহসী এ নারী বিতর্ক করার ক্ষমতা এবং ইংরেজি এবং হিন্দি উভয় ভাষায় নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার যোগ্যতা দিয়ে অনেকের নজর কাড়েন। তাকে ২০১৩ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির মিডিয়া কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়।
দুই বছর পর রাজ্যটিতে নতুন নির্বাচন হলে তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন। নুপূর জিতবেন এটা কেউ আশা করেননি। কিন্তু উদ্যমী প্রচারণা তাকে আরো বেশি করে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে নিয়ে আসে। তাকে দিল্লিতে দলের দাপ্তরিক মুখপাত্র নিযুক্ত করা হয়। ২০২০ সালে তিনি হন বিজেপির ‘জাতীয় মুখপাত্র’। গত কয়েক বছরে নুপূর শর্মা ভারতীয় টিভি দর্শকদের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। বেশিরভাগ সন্ধ্যায় তাকে টিভিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি চিৎকার চেচামেচি এবং হেনস্তা করতে দেখা যায়। এমনকি তাদের গালমন্দও করেন তিনি।
সম্প্রতি টুইটারে সমর্থকদের ব্যাপকভাবে শেয়ার করা এক ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় নুপূর একজনসহ আলোচককে ‘বাজেরকম ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী’ অভিহিত করে তাকে ‘মুখ বন্ধ’ করতে বলছেন। দল থেকে বহিষ্কারের পরে এক বিবৃতিতে নুপূর শর্মা লিখেছেন, তিনি ‘নিঃশর্তভাবে’ তার মন্তব্য প্রত্যাহার করছেন। কিন্তু নিজের মন্তব্যকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে তিনি দাবি করেন, ‘হিন্দু দেবতা শিবের প্রতি ক্রমাগত অপমান এবং অসম্মানের’ প্রতিক্রিয়া হিসাবেই ওই কথা বলেছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, উত্তর প্রদেশের জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বিতর্কের সময় নুপূর তার আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। হিন্দুদের অনেকে দাবি করেন তাদের পবিত্র শহর বারাণসীর এ মসজিদটি ষোড়শ শতকের একটি বিশাল হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত। তারা বলছেন, ১৬৬৯ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলেন। এ কারণ দেখিয়ে হিন্দুদের কেউ কেউ এখন জ্ঞানবাপি মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে প্রার্থনা করার জন্য আদালতের অনুমতি চাইছেন।
এ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে আদালত এক বিতর্কিত আদেশে মসজিদের ভেতরে ভিডিওর মাধ্যমে সমীক্ষার অনুমতি দেয়। এ ভিডিও রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হয়, মসজিদে একটি দণ্ডাকার পাথর দেখা গেছে। প্রার্থনার আবেদনকারীরা দাবি করছে তা একটি শিবলিঙ্গ অর্থাৎ শিবের প্রতীক। কিন্তু মসজিদ কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছে এটি নিছক একটি পানির ফোয়ারা।
বিরোধটি আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু টিভি চ্যানেলগুলোতে অবিরাম দাবি ও পাল্টা দাবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। নুপূর শর্মা এ বিষয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক সোচ্চার প্রবক্তা। তবে ২৭ মে নবি মুহাম্মদ (স.)-এর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বর্তমান বিপাকে পড়েছেন।
সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়ের টুইটারে নুপূরের বিষোদগারের ক্ষোভের একটি ক্লিপ শেয়ার করার পর বিজেপি নেত্রী দিল্লি পুলিশকে টুইট করে বলেন, তার বিরুদ্ধে একের পর এক ধর্ষণ ও হত্যা এবং বোন, মা, বাবা এবং তার নিজের বিরুদ্ধে শিরশ্ছেদ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
টুইটগুলোতে নুপূর প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাকে ট্যাগ করেন। এর তিন দিন পরে এক সহানুভূতিশীল সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে নুপূর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দলীয় সভাপতির কার্যালয় আমার পেছনে আছে। ’
কিন্তু গত শুক্রবার উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে নুপূরের মন্তব্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলে তার জন্য সমস্যা বাড়তে শুরু করে। কট্টরপন্থী হিন্দু যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন রাজ্যটির সরকার মুসলিম বিক্ষোভকারীদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেয়। পুলিশ শত শত মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
কিন্তু নুপূর শর্মা এবং বিজেপি আর বিষয়টি উপেক্ষা করা অব্যাহত রাখতে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ওই বিতর্কিত বক্তব্যের নিন্দা করা শুরু করার পর। কুয়েত, ইরান ও কাতার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে এবং সৌদি আরব কড়া বিবৃতি দিয়েছে। এমনকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাতও ওই মন্তব্যের সমালোচনা করেছে।
সাম্প্রতিক কয়েকদিনে নুপূর শর্মাকে তার ‘ধর্মীয় অবমাননাকর মন্তব্যের’ জন্য গ্রেপ্তার করার দাবি আরো জোরদার হয়েছে। ভারতের কয়েকটি বিরোধীদল শাসিত রাজ্যে পুলিশ তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। মঙ্গলবার একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছ থেকে নুপূরের জীবনের প্রতি হুমকির কথা উল্লেখ করে তার নিরাপত্তা জোরদার করেছে দিল্লি পুলিশ।
কিন্তু দলীয় পদে স্থগিতাদেশের পর থেকে নুপূরের জন্য সমর্থনও বাড়ছে। তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ হচ্ছে। কিছু ভাষ্যকার এ কথাও উল্লেখ করেছেন, অনেক শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় রাজনীতিবিদই ঘৃণাসূচক মন্তব্য করে পার পেয়ে গেছেন। আর তাই এই বিতর্কটিও হয়তো নুপূর শর্মার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ডেকে আনবে না। সূত্র: বিবিসি