বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর জন্য দেশে ১ হাজার ৫২০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। তাদের লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এসব লাইসেন্সের বিপরীতে সরকার লাখ লাখ টাকা জামানত নিয়েছে। তাদের ওপর নজরদারি কিংবা নিয়ন্ত্রণও করছে সরকার। অথচ কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাবে, তা বাছাই করবে মালয়েশিয়া।
কিসের ভিত্তিতে কোন মানদণ্ডে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়া নির্ধারণ করবে- এমন প্রশ্ন খাতসংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, মালয়েশিয়া কীভাবে ‘ক্রাইটেরিয়া ফিক্স’ কিংবা সিলেকশন করবে? এটা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের। এটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। মালয়েশিয়া সরকার কি এ বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে যোগ্য এজেন্সির কোনো তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়েছে? যাদের বাছাই করা হয়েছে, তাদের রেকর্ড কি মালয়েশিয়া যাচাই করেছে? এসব এজেন্সির মালিক কে, বাকগ্র্যাউন্ড কী, তাদের অফিস কেমন, ফ্যাসিলিটি আছে কিনা, আগে কর্মী পাঠানোর অভিজ্ঞতা আছে কিনা, কিসের ভিত্তিতে তারা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে?
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে দুই দেশের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তাতে ২৫ এজেন্সির বিষয়ে কোনো কথা উল্লেখ নেই। আর বাংলাদেশের সব লাইসেন্সের ‘স্ট্যাটাস’ একই। সরকারের নিয়মনীতি মেনেই লাখ লাখ টাকা সরকারি ফি দিয়ে ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স নিয়েছেন। এখানে কোনো ক্যাটাগরি নেই। এজেন্সির যে কোনো অনিয়মে নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই অপরাধ ভেদে শাস্তি ও আইননানুগ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকার কীভাবে জেনেশুনে সমঝোতা স্মারকে মালয়েশিয়া সরকারকে এজেন্সি সিলেক্ট করার অধিকার দিল, যেখানে এজেন্সির ‘কর্মদক্ষতা’ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য আছে বিএমইটিতে। এসব এজেন্সির নাম ছাড়া মালয়েশিয়া সরকারের কাছে কোনো তথ্যই নেই। তা হলে কিসের ভিত্তিতে ২৫ এজেন্সি বাছাই হলো? বাছাইয়ের পদ্ধতিটা কী? ২৫ এজেন্সির তালিকায় যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, এদের বেশির ভাগেরই কর্মী পাঠানোর তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনও এজন্সি আছে, যারা একজন কর্মীও কোথাও পাঠায়নি। বাংলাদেশ সরকার ত্রুটিপূর্ণ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে অনেক বড় ভুল করেছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠাতে গত ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ। এর পর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম দাতো শ্রি সারাভানান জানান, ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি এবং তাদের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে আরও ১০টি এজেন্সি কাজ করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ‘মূল’ বা ‘সহযোগীর’ কথা বলা নেই।
এই চিঠির আপত্তি জানিয়ে ১৮ জনুয়ারি পাল্টা চিঠি দেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। ওই চিঠিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন (আইএলও)’ এবং ‘বাংলাদেশ কম্পিটিশন অ্যাক্ট, ২০১২’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়- বাংলাদেশ সরকার সীমিত সংখ্যক এজেন্সিকে কাজ দিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বৈধ লাইসেন্সধারী সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সমান সুযোগ দিতে হবে।
এ বিষয়ে পার্লামেন্টারি ককাসের সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি আমাদের সময়কে বলেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া সরকার শর্ত দিয়েছে, সেটি বাংলাদেশ সরকার মেনে নিয়েছে; সমস্যাটা এখানেই হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের শর্ত না মানলে এই সমস্যা হতো না। অভিজ্ঞতা বলছে, সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভালো নয়। এর ফলে গুটি কয়েকজন লাভবান হয়, অধিকাংশই বঞ্চিত হয়।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখেছি, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী একটি কথা পরিষ্কার বলেছেন- সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) অনুযায়ী লাইসেন্স সিলেকশন করার দায়িত্ব মালয়েশিয়া সরকারের। মন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, এটা তাদের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেবে, কারা বাংলাদেশ থেকে কাজ করবে, আর কারা করবে না। এর অর্থই হচ্ছে চুক্তিতে আমাদের মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়া সরকারকে সেই কর্তৃত্ব দিয়ে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বলার কিছু নেই। এমন কর্তৃত্ব একটি মন্ত্রণালয় যদি আরেকটি মন্ত্রণালয়কে দিয়ে রাখে, সেখানে বলার মতো আর কিছু থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে মন্ত্রণালয় লাইসেন্স দিয়েছে, তারাই জানে আমাদের কার কী অবস্থা! কার সক্ষমতা আছে, কার নেই। আমাদের লাইসেন্সের কার কী অবস্থা, সেটা মালয়েশিয়া সরকারের জানার কথা নয়। এখানে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে- মালয়েশিয়া সরকার কীভাবে জানবে কোন লাইসেন্সের কী অবস্থা কিংবা কার দক্ষতা কতখানি?’
শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মালয়েশিয়া বলেছে, স্বচ্ছতার সঙ্গে তারা রিক্রুটিং এজেন্সি যাচাই করবে; কিন্তু স্বচ্ছ পদ্ধতির গাইডলাইনটা কী, সেটা আমরা জানি না।’ তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসায় যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন, তাদের জন্য দুর্ভাগ্য। তবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি বঞ্চিত হয়েছে। ১৪ বছর ধরে এখানে কর্মী পাঠাতে পারেনি। আগামীতেও পারবে না। তা হলে এত টাকা দিয়ে লাইসেন্স করার অর্থ কী?’
বায়রার সাবেক অর্থসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো সরকার লাইসেন্স সিলেকশন করতে পারে না। সরকার ব্যবসা করে না, ব্যবসা করেন ব্যবসায়ীরা। যারা কর্মী নেবেন, অর্থাৎ নিয়োগকর্তাই লাইসেন্স সিলেকশন করবেন। এ নিয়মেই চলে আসছে। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।’
সূত্র বলছে, ২৫ সিন্ডিকেটের মধ্যে এক পরিবারেরই তিন লাইসেন্স কাজ পেতে যাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে এক মন্ত্রীর স্ত্রীর লাইসেন্স; রয়েছে তিন সংসদ সদস্য। এটা কোন পদ্ধতিতে বাছাই করা হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে এজেন্সি বাছাই করা হবে; কিন্তু তিন এজেন্সি এক পরিবারের হলে সেখানে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা কতখানি মানা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।