ফের সুপার পাওয়ার হতে চায় জাপান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত হওয়ার পর জাপান সামরিক উন্নয়নের পেছনে তেমন বিনিয়োগ করেনি। ওই সময় দেশটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই মনোনিবেশ করে। তার ফলও আজ হাতে-নাতে পাচ্ছে দেশটির জনগণ। বর্তমানে দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রশ্নাতীত। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটি জাপান। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে মহাদেশীয় ভূরাজনীতিতে এরই মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে দেশটি। দীর্ঘ কয়েক যুগ পর জাপানের সামরিক শক্তিও সম্প্রসারণ হচ্ছে দ্রুতগতিতে। সক্ষমতা ও প্রভাবসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় বর্তমানে জাপানকেই এশিয়ার পরবর্তী সুপারপাওয়ার হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত জাপানের পরিচিতি ছিল শুধু অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে দশকের পর দশক ধরে সামরিক শক্তি বলতে তেমন কিছু ছিল না দেশটির। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সে ধারায় পরিবর্তন এনেছে দেশটি। ক্রমেই সামরিক শক্তি বাড়িয়ে তুলেছে। এরই মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের অন্যতম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে জাপান।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক পিটার জেইহানও জাপানকে দেখছেন এশিয়ার পরবর্তী সুপারপাওয়ার হিসেবে। তার ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক দশক ছিল বিশ্বায়নের জয়জয়কার। বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় জায়গায় উঠে এসেছে। কিন্তু বর্তমান যুগে সারা পৃথিবীতেই বিশ্বায়নের সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে কমেছে বিশ্বায়নের আবেদনও। এর ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তিও কমে আসছে। নিরাপত্তা কাঠামো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন কিছু সুপারপাওয়ার তৈরি করতে যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকায় আর্জেন্টিনা, ইউরোপে ফ্রান্স ও তুরস্ক এবং এশিয়ায় জাপান এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাপানের নিজেকে এশিয়ার সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা এখন স্পষ্ট। চীনকে ঠেকানোর তাগিদ থেকে দেশটির উত্থানে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরও। এ মুহূর্তে জাপানের এ ইচ্ছা পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধাগুলো দেশটির অভ্যন্তরেই তৈরি হয়ে আছে। দেশটির বড় একটি অংশ এখন বয়োবৃদ্ধ। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিও খুব একটা গতিশীল নয়। সামনের দিনগুলোয় জনশক্তির ঘাটতিতে পড়তে পারে দেশটি। আবার এ মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবেও স্ট্যাগফ্লেশনে (উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের বিপরীতে নিম্ন প্রবৃদ্ধি) ভুগছে জাপান। এ ছাড়া, দেশটির জিডিপির বিপরীতে ঋণের পরিমাণও অনেক বেশি।

তবে শক্তিশালী ভোক্তাশ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে এসব সংকট কাটিয়ে ওঠাও দেশটির পক্ষে তেমন একটা কঠিন নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুপারপাওয়ার হওয়ার পথে বিদ্যমান জনমিতিক ও অর্থনৈতিক বাধাগুলো জাপান সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশাবাদী পিটার জেইহানও। তার বক্তব্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সম্পদেরই সংকট রয়েছে। একই সঙ্গে জনমিতিক ও অর্থনৈতিক বাধাও অনেক। এ ছাড়া, দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানও এশিয়ার দূরতম স্থানে, যা দেশটিকে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনেও নাজুক অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। আবার এসব সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সব উপাদানই জাপানে বিদ্যমান রয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও শিল্প খাতের অভিনব মডেলকে কাজে লাগিয়ে দেশটি সহজেই এসব সংকটের সমাধান করতে পেরেছে। জাপানকে বলা চলে বিশ্বের ইতিহাসে প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রসর সমাজ হিসেবে।

শিল্প খাতের বেশকিছু ইউনিট এরই মধ্যে বিশ্বের উন্নয়নশীল কিছু দেশে স্থানান্তর করেছে জাপান। শিল্প ইউনিটগুলোর কাঁচামাল ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ওইসব দেশের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। এসব শিল্পের মুনাফা ও আয় জাপানে প্রবেশ করছে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে। আবার বেকারত্ব ও কর্মহীনতার কারণে জাপানের রাজস্ব আয় হ্রাসের ক্ষতিও এর মধ্য দিয়ে অনেকটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে।

‘ডিজইউনাইটেড নেশনস: দ্য স্ক্র্যাম্বল ফর পাওয়ার ইন অ্যান আনগভার্নড ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এক বইয়ে এ নিয়ে আরো বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন পিটার জেইহান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত অক্ষশক্তির অন্যতম দেশ ছিল জাপান। এর আগ পর্যন্ত দেশটিকে ধরা হতো এশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিগুলোর একটি হিসেবে। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল দেশটি। বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর দেশটিকে সব ধরনের সামরিক শক্তি পরিত্যাগে বাধ্য করেছিল মিত্রপক্ষ। নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠেছিল দেশটি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আবারো সামরিক শক্তি গড়ে তোলায় মনোযোগী হয় জাপান। এর কারণ হিসেবে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের ক্রমেই শক্তিশালী ও আগ্রাসী হয়ে ওঠার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন দেশটির কর্তাব্যক্তিরা। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সময়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এশিয়ার সামরিক নিরাপত্তা কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে জাপান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সংবিধানে সব ধরনের যুদ্ধকে পরিত্যাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। গত দশকের প্রথমার্ধে এ দৃষ্টিভঙ্গিকেই পরিত্যাগ করার ঘোষণা দেয় জাপান। জাতীয় নিরাপত্তার তাগিদে জাপানি সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ধারায় (অনুচ্ছেদ ৯) পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে ঘোষণা দেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।

ওই সময়ে উত্তর কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিরোধ তার এ ঘোষণার পক্ষে জনমতও গড়ে তোলে। উত্তর কোরিয়ার নিক্ষিপ্ত কয়েকটি মিসাইল জাপানি সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চীনের সঙ্গে বিরোধও জোরালো হয়ে ওঠে। দ্বীপপুঞ্জটির আকাশসীমা ও নৌসীমায় চীনা যুদ্ধবিমান এবং জলযান অনুপ্রবেশেরও অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাপানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দাবিও জোরালো হয়ে উঠতে থাকে।

২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাপানের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল ডায়েট নতুন এক আইন পাস করে। এর আওতায় জাপানের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (জেএসডিএফ) প্রথমবারের মতো সাংবিধানিকভাবে মিত্রদের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষার অনুমোদন দেয়া হয়। মিত্রদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব ধরনের সহায়তা (যুদ্ধ সরঞ্জাম, জনবল) দেয়ারও অনুমোদন দেয়া হয়।

একই সঙ্গে এতে বলা হয়, আক্রমণের শিকার কোনো মিত্রকে যুদ্ধে সহায়তা না দেয়ার অর্থ হলো মিত্রতার বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া ও জাপানকে আরো বিপদগ্রস্ত করে তোলা। এ আইনকেই বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের সামরিকায়নের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।

আইনটি জাপানকে ভূরাজনৈতিকভাবে আরো অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, আইনটির মাধ্যমে চীনকে মোকাবেলায় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে সামরিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার পথে সব ধরনের আইনি ও সাংবিধানিক বাধা অপসারণ করা হয়েছে। ইন্দোপ্যাসিফিকে সামরিকভাবে আরো সক্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে জাপান। একই সঙ্গে পেয়েছে সুপারপাওয়ার হওয়ার পথে আরো এক ধাপ অগ্রসর হওয়ার সুুযোগ।