রোসান্নে হোয়াইট। ৮ বছর আগে প্রথমবার ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছিলেন। পরে একটি কিডনি হারান তিনি। পাঁচ বছর আগে ক্যান্সার ফের শরীরে হানা দেওয়ায় শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বোর একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ গত মে মাসে বেভাসিজুমাব ইনজেকশন দিয়ে রোসান্নের চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। একই চিকিৎসা ৮ বছর আগে তাকে দিয়েছিলেন এই চিকিৎসক।
৫৮ বছর বয়সী লঙ্কান অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হোয়াইট। তিনি বলেন, দেশের সার্বজনীন সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় তিনি বিনামূল্যে ক্যান্সারের ইনজেকশন পেতেন। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটিতে অনেকেই বিনামূল্যে এই ইনজেকশন পান।
ইনজেকশনটি ১৩ বার নেওয়ার পর এখন সরকারি হাসপাতালে সেটি আর মিলছে না বলে জানিয়েছেন হোয়াইট। ইন্সুরেন্স না থাকার কারণে বেসরকারি বাজারে এখন এক ডোজ টিকার দাম পড়ছে ১ লাখ ১৩ হাজার লঙ্কান রুপি। ফলে যে সীমিত সঞ্চয় ছিল হোয়াইটের তা এই ওষুধ কেনায় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছে কি-না তা জানতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে আমাদের এখন হাসপাতালে ফোন করতে হয়। কিন্তু নার্সরা যখন বলেন, হাসপাতালে ওষুধ নেই, তখন আপনি কী করবেন?’
বেভাসিজুমাব খুঁজে পেতে হোয়াইটকে যে লড়াই করতে হচ্ছে, তা চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে তার প্রাথমিক লক্ষণ। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ঘাটতি ছাড়াও কিছু চিকিৎসা এবং রোগীদের রোগ নির্ণয়ের টেস্টও স্থগিত করা হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অভাবে ওষুধ, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী আমদানি করতে পারছে না দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে নেতৃত্বাধীন সরকার। যে কারণে দেশটিতে চরম বিদ্যুৎ সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কল-কারখানার উৎপাদনও। চরম অর্থনৈতিক এই সঙ্কটের জন্য সরকারকে দায়ী করে প্রত্যেকদিন দেশটির হাজার হাজার মানুষ ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স শ্রীলঙ্কার সরকারি দু’জন কর্মকর্তা, ছয়জন চিকিৎসক ও একজন স্বাস্থ্যসেবা ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলেছেন, আগে কখনই শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে তারা এত খারাপ হতে দেখেননি।
কলম্বোর অন্যতম সরকারি একটি হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ মেমো দেখেছে রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং সরঞ্জামের সরবরাহ ঘাটতির কারণে ৭ এপ্রিল থেকে কেবলমাত্র জরুরি, দুর্ঘটনায় আহত এবং ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার করা হবে।
দেশটির স্বাস্থ্যখাত যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে রয়টার্সের করা প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র পর্যটন খাতের আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশটির পর্যটন খাতে ব্যাপক ধস নেমেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় এর দামও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটিতে।
কিছু অর্থনীতিবিদ বলছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা, বছরের পর বছর ধরে ঋণ নিলেও পরিশোধের ব্যবস্থা না করা এবং ২০১৯ সালে অযৌক্তিক শুল্ক কাটছাঁট এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ সহায়তার আলোচনা পিছিয়ে যাওয়ায় চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে আইএমএফের ঋণ সহায়তার বিষয়ে এখন আলোচনা শুরু হয়েছে।
রাজাপাকসের ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী বলেছেন, অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য শুল্ক কাটছাঁট করা হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার; যা দিয়ে এক মাসেরও আমদানির ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। দেশটির মেডিক্যাল কর্মীদের সবচেয়ে পুরোনো সংস্থা শ্রীলঙ্কা মেডিক্যাল এসোসিয়েশন গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে সতর্ক করে দিয়ে একটি চিঠি লিখেছে। এতে বলা হয়, আগামী দিনে জরুরি চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সংস্থাটি বলেছে, ‘এর ফলে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটবে; যা বিপর্যয়কর হবে।’
গুরুত্বপূর্ণ ৫ মিনিট
গত মার্চের শেষের দিকে ৭০ বছর বয়সী অসুস্থ এক নারীকে কলম্বো শহরতলীর একটি সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেপটিক শকে ছিলেন তিনি। যার ফলে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
ওই নারীকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক বলেছেন, ‘রোগীকে আসলে সেই মুহূর্তে অ্যালবুমিন ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই রোগীর জন্য টিকা পাওয়া যায়নি। এর অর্থ হলো, আমি গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ মিনিট হারিয়েছি।’
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় হাসপাতালের এই চিকিৎসক নাম প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই রোগীকে বাঁচানো যায়নি।’
শ্রীলঙ্কার ফার্মাসিউটিক্যালস মন্ত্রণালয়ের সচিব সামান রথনায়েকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালে যে এক হাজার ৩২৫ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়, তার মধ্যে জীবন-রক্ষাকারী তিনটি ওষুধ একেবারে ফুরিয়ে গেছে এবং অন্যান্য ১৪০টি প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দুই মাসেও এই পরিস্থিতির সমাধান হবে না। ডলারের সঙ্কট চলবে।’ তবে সরবরাহের নতুন উৎস তাৎক্ষণিক ঘাটতি দূরে সাহায্য করতে পারে।’
‘আমরা লড়াই করছি’
গত সপ্তাহের শেষের দিকে কলম্বোর উত্তরাঞ্চলের একটি বড় সরকারি হাসপাতালের হলে প্লাস্টিকের চেয়ার এবং কাঠের বেঞ্চে অনেক রোগীকে বসে থাকতে দেখা যায়। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের অন্যতম প্রধান এই নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আড়াই হাজারের বেশি কর্মী রয়েছেন। এই কর্মীরা মাসে প্রায় ৫০ হাজার রোগীকে সেবা দেন।
নিজের এবং হাসপাতালের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনও লড়াই করছি। কিন্তু আমি জানি না, আমরা কতদিন সেবা চালু রাখতে পারবো।
গত বছরের আগস্টে দেশটিতে যখন অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরুর লক্ষণ দেখা যায়, তখন ওই হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বড় ধরনের সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সেই অর্থ চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধের সরবরাহের জন্য ব্যয় করা হয়।
গত কয়েক সপ্তাহে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে শ্রীলঙ্কায় মেডিক্যাল ওষুধ ও সরঞ্জামের ব্যয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে ওই হাসপাতালের অর্থায়নে আরও চাপ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালটি সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন রুপি ঋণ করেছে।
সামান রথনায়েকে বলেন, মোটাদাগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল গ্লোভস ও রিএজেন্টের মতো পণ্য সরবরাহকারীরা সরকারের কাছে প্রায় ৪ বিলিয়ন রুপি পাওনা রয়েছে।
গত শনিবার শ্রীলঙ্কার নতুন অর্থমন্ত্রী আলী সাবরি রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ স্থিতিশীল করাই তার প্রথম অগ্রাধিকারের বিষয়।
কিন্তু হোয়াইটের মতো যারা জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের জন্য এই সঙ্কট সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য মরফিন ট্যাবলেটও প্রায় মিলছে না।
হোয়াইট বলেন, ‘একদিন আমার ছেলে এই ওষুধের জন্যও গেল, কিন্তু সে শূন্য হাতে ফিরে এসেছে। আমি একদম অসহায় বোধ করছি… আমি প্রতিবাদও করতে পারছি না।’