অনাস্থা ভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান; কিন্তু এখন তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) পার্লামেন্ট সদস্যরা কী করবেন— তা নিয়ে দলের হাইকমান্ডের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। দলের নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্যে এ বিষয়ে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে খানিকটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো।
সদ্য বিদায় নেওয়া পিটিআই সরকারের পার্লামেন্ট বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলি মুহম্মদ খান রোববার পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর সংবাদিকদের জানান, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পিটিআইয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি এমপি পদত্যাগ করার বিপক্ষে।
এদিকে, আলি মুহম্মদ খান এই মন্তব্য করার ঘণ্টাখানেক আগে পিটিআইয়ের শীর্ষ নির্বহী কমিটির অন্যতম নেতা ও সাবেক সরকারের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দলের হাইকমান্ড মনে করে— পার্লামেন্টের সব পিটিআই এমপিদের পদত্যাগ করা উচিত।
পিটিআইয়ের অধিকাংশ এমপি ইতমধ্যে ইমরান খানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন— উল্লেখ করে রোববার রাজধানী ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে ফাওয়াদ চৌধুরি বলেন, ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সব পিটিআই এমপি আগামীকাল (সোমবার) পদত্যাগ করবেন। এটি দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত।’
পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম জিও নিউজ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রিত্বের অবসানের পর বানি গালায় যে বাড়িতে ইমরান খান উঠেছেন, সেখানে তার সভাপতিত্বে পিটিআই নেতাদের এক বৈঠক হয়।
সেই বৈঠকের পর আলাদাভাবে সাংবাদিকদের সামনে আসেন ফাওয়াদ ও কুরেশি। ফাওয়াদের সঙ্গে ছিলেন সদ্য সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী হাম্মাদ আজহার ও সদ্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফারুখ হাবিব।
ফাওয়াদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী হতে মুসলিম লিগ (নওয়াজ) নেতা শাহবাজ শরিফের মনোনয়নপত্র পার্লামেন্ট গ্রহণের প্রতিবাদে এমপিদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্ষমতা হারানো পিটিআই গণবিক্ষোভ চালিয়ে যাবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান ফাওয়াদ।
তবে ফাওয়াদ চৌধুরির সংবাদ সম্মেলনের ঘণ্টাখানেক পর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পিটিআইয়ের পার্লামেন্ট বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলী মুহম্মদ খান সাংবাদিকদের জানান, দলের ৯৫ শতাংশ এমপি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করতে সম্মত নন।
তিনি বলেন, ‘যে কোনো রাজনীতিবদের জন্যই পদত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অস্ত্র; কিন্তু দলের এমপিরা মনে করছেন— এই মুহূর্তে পার্লামেন্ট থেকে সবাই পদত্যাগ করলে বিরোধীদের আরও সুযোগ করে দেওয়া হবে।’
পার্লামেন্ট অর্থাৎ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা ভোটের পর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই রোববার পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতার কাছ থেকে দুই রকম বক্তব্য এলো। তবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকে উদ্ধৃত করে পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক ডন জানিয়েছে, এমপিদের পদত্যাগের বিষয়ে এখনও চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
পাকিস্তানের ৩৪২ সদস্যের পার্লামেন্টে এখনও এককভাবে ইমরানের দল পিটিআইর সদস্য বেশি। এই দলের ১৫৫ জন রয়েছে পার্লামেন্টে। শাহবাজের দল মুসলিম লিগের সদস্য ৮৪ জন। প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপির সদস্য ৫৬ জন, যে দলের নেতৃত্ব এখন দিচ্ছেন বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো। সফল ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান ২০১৮ সালে দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ, বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
তবে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সেনা শাসনে থাকা পাকিস্তানে তার ক্ষমতা আরোহনের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর আশির্বাদ ছিল বলেই মনে করা হয়। যার উপর ভর করে বড় দুই দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও মুসলিম লিগকে (নওয়াজ) হটিয়ে ক্ষমতায় বসেন তিনি। সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কের অবনতির মধ্যে বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে জাতীয় পরিষদে।
সেটা আটকাতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার মতো কৌশল ইমরান করলেও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তা আটকে দেয়। আদালতের আদেশেই শনিবার মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটে ইমরানের বিদায় ঘণ্টা বাজে। তার আগে জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কাইসার ও ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি পদত্যাগ করেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো সরকার প্রধান মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারলেও ইমরানের আগে আর কাউকে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়নি। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের জনগণকে মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইমরান। ক্ষমতা হারানোর পর প্রথম টুইটে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার সংগ্রাম আজ শুরু হল, ক্ষমতা পরিবর্তনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার কাজটি বরাবর জনগণই করে আসছে।’