ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ভেস্তে দিতে এক জোট হয়েছে প্রতিটি পশ্চিমা দেশ। যার মূল ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে রাশিয়ার চির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জি-৭ নেতাদের বৈঠকে ইউক্রেনে রাশিয়াকে ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে পশ্চিমা নেতাদের। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার প্রতি আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ, রুশ তেল-গ্যাসের বিকল্প ভাবনা, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সেনা উপস্থিতি বাড়ানো, ইউক্রেনের শরণার্থীদের গ্রহণ ইত্যাদি। পশ্চিমা এসব পদক্ষেপের ওপর ভর করে ইউক্রেনও রাশিয়াকে ঠেকিয়ে দিতে ধীরে ধীরে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তবে অর্থনীতিতে এসব পদক্ষেপের মারাত্মক প্রভাব সত্ত্বেও মস্কো বলেছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় তারা পাত্তা দিচ্ছে না। রাশিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের প্রতি একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিলে মস্কোর সরকারের উদ্দেশ্য পূরণে তার প্রভাব পড়বে বলে যদি পশ্চিমারা ভেবে থাকে, তবে সেটি হবে তাদের বোকামি।
রাশিয়াবিরোধী এই পশ্চিমা ঐক্যে যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে চাইছে গত বুধবার ব্রাসেলসের বৈঠকে তা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে বৈঠকের আগে রাশিয়ার আইনসভার অন্তত ৩০০ সদস্যের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ইউক্রেন থেকে পালানো এক লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হবে বলেও জানায় তারা। এ ছাড়া ইউরোপে রুশ তেল-গ্যাসে নির্ভরতা কমাতেও যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিচ্ছে। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ইইউর সঙ্গে চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোতে এ বছরই ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক তরল গ্যাস সরবরাহ করবে। এ ছাড়া পূর্ব ইউরোপের চার দেশে ন্যাটো যে সেনাসংখ্যা বাড়াচ্ছে তাতেও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেবে। ইউক্রেন থেকে পালানো শরণার্থীদের দেখতে গতকাল পোল্যান্ডেও গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারা ২০ হাজারের বেশি শরণার্থী গ্রহণ করবে। জার্মানি নেবে আড়াই লাখের বেশি শরণার্থী।
ব্রাসেলসে ন্যাটো ও জি-৭-এর বৈঠক শেষে এক বক্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র ব্যবহার করলে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তার জবাব দেবে। যদিও কী সেই জবাব তা স্পষ্ট করেননি বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও বলেন, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে তার পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও বলেছেন, ইউক্রেনে যদি রাশিয়া রাসায়নিক বা জৈবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে তাহলে সেটি হবে সব নিয়ম, সব চুক্তি এবং সব বিদ্যমান প্রথার লঙ্ঘন। আমরা শুধু রাশিয়াকে এটাই বলব, ভুলেও এসব অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা করবেন না। রাশিয়াকে একই বিষয়ে সাবধান করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টল্টেনবার্গও।
পশ্চিমা এই ঐক্য আশাবাদী করে তুলেছে যুদ্ধের শিকার ইউক্রেনকে। বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় কাউন্সিলের শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাদের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য পশ্চিমা নেতাদের ধন্যবাদ জানান। যদিও রাশিয়াকে থামাতে ইউরোপ অনেক দেরি করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পশ্চিমা এসব পদক্ষেপের গতকাল কড়া জবাব দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমিরি পুতিন। দেশটির বার্তা সংস্থা আরআইএকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব কিছুর বিরুদ্ধে পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এমনকি রুশ লেখকদের বইও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো করে আমাদের দমানো যাবে না। রাশিয়া পশ্চিমাদের মতো এমনটি করবে না। আমাদের পক্ষে এসব বৈষম্য কল্পনা করা অসম্ভব। রাশিয়ায় অসহিষ্ণুতার কোনো জায়গা নেই।’ সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দেশটির নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রুশ সরকারে প্রভাব পড়বে ভাবলে সেটা হবে বোকামি। ইউক্রেইনে ক্রেমলিনের সামরিক অভিযানের পক্ষে যে রাশিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের সমর্থন আছে, তা বিভিন্ন জনমত জরিপেই দেখা যাচ্ছে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার যুদ্ধের এক মাস পূর্তির দিনে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত আছে। তবে কোথাও কোথাও পাল্টা প্রতিরোধেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। রাজধানী কিয়েভের আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরের পুনঃনিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। খারকিভে একটি মেডিক্যাল সেন্টারে রুশ হামলায় এদিন ৪ জন নিহত হয়েছে। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন্দর নগরী মারিউপোল একটি গণকবরে ২০০টি লাশ দাফন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা। ৯ দিন আগে শহরের একটি থিয়েটার হাউসে রুশ হামলায় অন্তত ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানান শহরের মেয়র। কিয়েভের কাছে একটি জ্বালানি ডিপোতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দাবি করেছে রাশিয়া।
যুদ্ধ বন্ধে সমঝোতার ইঙ্গিত
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান বন্ধে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান জানিয়েছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ অবসানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। উভয় দেশের মধ্যে মূল ৬টি বিরোধের মধ্যে চারটির বিষয়ে সমঝোতা হতে যাচ্ছে। যে চারটি ইস্যুতে উভয় দেশ সমঝোতায় পৌঁছেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ন্যাটোতে ইউক্রেনের না যাওয়া, আংশিক নিরস্ত্রিকরণ, সম্মিলিত নিরাপত্তা ও রুশ ভাষাভাষীদের নিরাপত্তা। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে তুরস্ক। উভয় দেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গেই তুরস্কের যোগাযোগ রয়েছে।