ঐক্যবদ্ধ অহিংস আন্দোলনে ছয় দশকেরও বেশি সময়ের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটেছে। লাল সবুজের পতাকার অধিকারে মিলেছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। ছয় দশকের গ্লানি শেষে নাগরিক সুবিধাসহ নিশ্চিত হয়েছে স্বাভাবিক নাগরিক জীবন। ছিটমহলের ভূমির সাথে পাওয়া নতুন নাগরিকদের স্বাগত জানিয়ে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবাসহ সড়ক নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করে সরকার আলোকিত করেছে এক সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিটমহলকে।
ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিটমহলের বাসিন্দারা পেয়েছে ভোট দানের অধিকার এমনকি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিদ্বদ্বিতা করার অধিকারও। একসময় যেখানে নারী নেতৃত্ব ছিল কল্পনাপ্রসূত সেই বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত সদস্য পদে প্রতিদ্বদ্বিতা করছেন দুই নারী। দাশিয়ারছড়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন তাদের সাহসিকতা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রা। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার মূল ভূমির সাথে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়া তাই নতুন এক ইতিহাসে সৃষ্টির অপেক্ষায়।
আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফুলবাড়ী ইউনিয়নের ২ নং নারী আসনে (৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড) সদস্য পদে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম এবং তানিয়া বেগম। একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়ে একই আসনে প্রতিদ্বদ্বিতা করলেও জয় পরাজয় তাদের কাছে মূখ্য নয়। বরং নারী হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার
সুযোগটাকে তারা স্বাচ্ছন্দে উপভোগ করছেন।
ভারতের শাসনাধীন দাশিয়ারছড়ার পঞ্চায়েত প্রধান (বোর্ড চেয়ারম্যান) ছিলেন তানিয়া বেগমের শশুর আজগর আলী। নিজের বোর্ড নির্বাচনে কখনও নারী নেতৃত্বের সুযোগ না থাকলেও পুত্রবধূকে এবার নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সুযোগ দিয়েছেন আজগর আলী। স্বামীসহ শ্বশুবাড়ির সকলে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তানিয়া বেগমকে বিজয়ী করতে। তানিয়ার প্রতীক তালগাছ। ‘নেতৃত্ব কিংবা নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করাতো দূরের কথা কখনও ভাবিনি নারী হয়ে আমরা ভোট দিতে পারবো।
ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে আমারা ভোটাধিকার পেয়েছি। আর এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এক সময়ের অসম্ভব ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছি। বাংলাদেশ সরকার ও বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা চির
কৃতজ্ঞ।’ নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতাকারী সদস্য প্রার্থী তানিয়া বেগম এভাবেই নিজের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলেন।তানিয়া বেগম জানান, ছিটমহল বিনিময়ের পর দাসিয়ারছড়ায় এখন প্রশাস্ত পাকা রাস্তা। প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। সুদৃশ্য মসজিদ-মন্দির, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল সেন্টার, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা হয়েছে। নানা
রকম উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বদলে গেছে এক নতুন জনপদ দাসিয়ারছড়া। উন্নয়নের প্রতিশ্রতি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চা না। বিজয়ী হলে জনগণের জন্য কী করবেন, জানতে চাইলে তানিয়া বেগম বলেন, ‘বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তি সহজতর করাই আমার প্রধান প্রতিশ্রুতি। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি সুবিধাসহ যাবতীয় নাগরিক সুবিধা পেতে নাগরিকদের যাতে কোনও হয়রানির শিকার হতে না হয় সেটা নিশ্চিত করাই হবে আমার প্রধান কাজ।
এছাড়াও বেকারত্ব দূরীকরণসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডকে তরান্বিত করতে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবো। ভোটারদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া পাচ্ছি। আমি সকলের দোয়া চাই।’ উন্নয়ণের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করে নাগরিকদের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ও অপর প্রতিদ্ব›দ্বী
প্রার্থী মর্জিনা বেগম। মাইক প্রতীক নিয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেওয়া এই নারী সদস্য প্রার্থী মর্জিনা বেগম জানান, দাসিয়ারছড়াবাসীর কষ্টের জীবণের অবসান হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যোন্নয়নের যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। নারী হয়ে এই যাত্রায় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে চান তিনি।
তিনি আরও বলেন,‘ সরকার দাসিয়ারছড়ার উন্নয়ণে অনেক বেশি অন্তরিক। বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এখানকার বাসিন্দারা নারীদের অধিকার ও নেতৃত্ব নিয়ে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া এখন দাসিয়ারছড়ার আনাচে কানাছে। আমি সেই পরিবর্তনের সৈনিক হয়ে নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে চাই। সেজন্যই আমার নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করা। আশাকরি জনগণ আমাকে বিজয়ী করে তাদের সেবায় অবদান রাখার সুযোগ দেবেন।’
একই ওয়ার্ড থেকে দুই নারী প্রার্থী একই পদে প্রতিদ্বদ্বিতা করলেও নারীদের অংশগ্রহণকে আশাব্যঞ্জক ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সাবেক ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের অন্যতম নেতা গোলাম
মোস্তফা ও আলতাফ হোসেন। এই দুই নেতা বলেন,‘ ছিটমহল বিনিময়ের মতো এটাও একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এই দুই নারী সাবেক ছিটমহলের ভবিষ্যত প্রজন্মের নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। তাদের জয় কিংবা পরাজয় আমাদের কাছে মূখ্য নয়। তাদের সাহসিকতা ও অগ্রগামীতা আমাদের আশার আলো।
আমি অবশ্যই তাদের সাফল্য কামনা করি।’ বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহলের সবচেয়ে বড় এবং আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেড কাউন্টিং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪ টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই
চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পায় এবং সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।