বাঙালির বাংলাদেশি হয়ে ওঠা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার মিরপুরের বাঙলা কলেজ। ১৯৬২ সালে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে এই কলেজটি। প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব হয় ১৯৬১ সালে। প্রথমে এটি বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব থাকলেও সেটি এখনো শুধু খাতাকলমেই।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকারদের নৃশংসতার সাক্ষী এই কলেজটি। ১৯৭১ সালে কলেজটি থেকে বাঙলা কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে উর্দু কলেজ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের সময়জুড়ে কলেজটিতে বাঙালিদের ধরে এনে চালানো হতো নির্যাতন। খুন, ধর্ষণ, হত্যাসহ জীবন্ত মানুষকে গলাকেটে হত্যা করা হতো এই কলেজের আঙ্গিনায়।
যুদ্ধকালে থাকা কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি আনোয়ারা বেগমের বক্তব্য থেকে নৃশংসতার চিত্র ফুটে উঠে।
তিনি বলেন, প্রশাসনিক ভবনের নিচের রুমগুলোকে টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে আটকে রেখে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো, ধর্ষণের পরে হত্যা করে সামনে থাকা জলাশয়ে (প্রশাসন ভবনের পিছনের জলাশয়) ফেলে দেওয়া হতো।
অধ্যক্ষের বাসভবনের যাওয়ার রাস্তার গাব গাছ ও বাসভবনের অাশপাশে থাকা আমগাছের শিকড়ের উপর মানুষ জবাই করা হতো।
প্রশাসন ভবনের সামনে একটি ঝোপঝাড় ছিল ওই ঝোপের মধ্যে নিয়েও পাকবাহিনী মেয়েদের ধর্ষণ করত। এছাড়াও কলেজের সামনে থাকা বিশালাকৃতির মাঠজুড়েই ছিল ঝোপঝাড়, যা ছিল পাক বাহিনীর ধর্ষণের কুঁড়েঘর।
তিনি আরো বলেন, কলেজের গেটের ডান পাশে (বর্তমানে ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন জায়গা) ছোট একটা পুকুর ছিল, হলের নিচু জায়গায়, বিজ্ঞান ভবনের কর্ণারে এবং জলাশয়ে মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হতো।
আনোয়ারা বেগম বলেন, আমাকে দিয়ে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের পরে রুমের রক্ত পরিষ্কার করাত। প্রথম দিকে মানুষের দুর্ঘন্ধে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে সেটা অভ্যেস হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলেজের ভেতরে পাওয়া মানুষের পচা-গলা লাশ দেখে নৃশংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় চিহ্নিত গণকবরের তালিকায় ও বাঙলা কলেজের বধ্যভূমির নামিআছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও গণকবর চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করতে পারেনি কলেজ প্রশাসন বা সরকার।
২০০৭ সালে তৌহিদুর রহমান ডিয়ারের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গণকবর চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন করে। তৎকালীন অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানার দপ্তরে গিয়ে স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবিতে স্মারকলিপি দিলে অধ্যক্ষ ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি ফালতু চাপ্টার’ বল্লে শিক্ষার্থীদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলে।
তবে আশার কথা হলো- বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খানের নেতৃত্বে গণকবর চিহ্নিতকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১০টি স্থানে গণকবরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এবং চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই গণকবর চিহ্নিত করেছি। স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ চলমান। মুজিববর্ষে বাঙলা কলেজের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার থাকবে।
গণকবরগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা- যাতে শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানিদের নির্মমতা সম্পর্কে জানতে পারে।