পিতা-মাতার শেষ বয়সের সম্বল বলতে থাকে একমাত্র তার সন্তান ও পরিবার। আর জীবনের শেষ সময়টা পরিবারের সাথে একটু হাসি আর আনন্দের মধ্য দিয়ে কাটানোর জন্যই সারা জীবন পরিশ্রম করে তিলে তিলে গড়ে তোলেন এক একটি পারিবারিক বন্ধন। কিন্তু শেষ বয়সে যদি কোনো সন্তান তার পিতা-মাতাকে পরিত্যাগ করে তবে সেই পিতা-মাতার মতো অসহায় আর কেউ থাকে না। শেষ জীবনের একমাত্র আশার প্রদীপ নিভে গিয়ে তারা হয়ে পড়েন দিশেহারা।
এবার এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশালের ৩নং ওয়ার্ডে।
ঘোড়াশালের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছেন তিনি। চলাচল করেন লাঠিতে ভর দিয়ে। বয়স প্রায় একশ। ছেলে-মেয়ে থাকার পরও স্বামীহারা এই বৃদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে একটি অন্ধকার ভাঙা ঘরে। ঘরের ভেতর একটি পুরনো তোশক। দু-চারটি থালা-বাসন ছাড়া ঘরে কিছুই নেই। অন্ধকার ঘরে একাকী দিন কেটে যাচ্ছে এই বৃদ্ধা মায়ের।
ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে জীবনের বাকিটা সময় সুখে-শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু সেই সুখ জোটেনি এ বৃদ্ধা মায়ের কপালে। স্ত্রীর কথামতো গর্ভধারিণী বৃদ্ধা মাকে অন্ধকার ভাঙা ঘরে ফেলে রেখেছে ছেলে। অথচ মায়ের ঘরের পাশেই রয়েছে ছেলের তিনতলা রাজকীয় বাড়ি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃদ্ধা মরিয়ম বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। স্বামী মারা গিয়েছেন প্রায় ২০ বছর আগে। বড় ছেলে কিরণ শিকদার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি ঘোড়াশাল পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাও করেন তিনি। সাজ ডেকোরেটর নামে একটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। পলাশ বাজার এলাকায় নিজের তিনতলা রাজকীয় বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন এই কিরণ শিকদার।
কিন্তু গত রমজান মাসে নতুন বাজার এলাকার গফুর মিয়ার ভাঙা একটি ঘরে বৃদ্ধা মাকে রেখে যান ছেলে কিরণ শিকদার। মাঝে মধ্যে এসে কিছু বাজার সদাই করে দিয়ে যান। তবে বৃদ্ধা মরিয়ম বেগমের দেখাশোনা করেন প্রতিবেশীরাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শতবর্ষী মরিয়ম বেগম বলেন, ছেলের বউ আমাকে তাদের সঙ্গে রাখতে চায় না। তাই আমাকে এখানে রেখে গেছে ছেলে। মাঝে মধ্যে এসে বাজার সদাই করে দিয়ে যায়। তা দিয়েই অন্ধকার ভাঙা ঘরে দিন কাটে আমার।
এ সময় মরিয়ম বেগম আরও বলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে অনেক কিছু চাওয়ার থাকলেও এখন কিছুই করার নেই আমার, আজ আমি অসহায়। আমার ইচ্ছা ছিল জীবনের শেষ সময়ে সন্তান, নাতি-নাতনিকে নিয়ে হাসি-খুশিতে দিন কাটাব। কিন্তু কপালে আমার সেই সুখ নেই। আমার ছেলের ইচ্ছা থাকলেও স্ত্রীর জন্য পারে না। আমাকে তাদের সঙ্গে রাখার কথা শুনলে স্ত্রী লিপি আক্তার ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে। এখানে আসার আগে চলনা এলাকার গ্রামের বাড়িতে একা একা দিন কাটিয়েছি আমি।
তারপর ছেলে গ্রামে গিয়ে বলল আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। ভাবছিলাম তার বাড়িতে তুলবে। পরে দেখি আমাকে এখানে ঘর ভাড়া করে দিয়েছে। এখানে ছেলে এসে খোঁজ-খবর নিলেও ছেলের বউ, নাতি-নাতনি কেউ আসে না। খোঁজ-খবর নেয় না। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর সেও খোঁজ-খবর নেয় না। আমি এখন সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি। মাঝে মধ্যে খুব একাকিত্ব লাগলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে সময় পার করি।
এছাড়াও মরিয়ম বেগম তার শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছি। চিকিৎসা না করায় প্রায় ১০ বছর আগে বাম পাশের চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এখন ডান পাশের চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। হয়তো এটিও নষ্ট হয়ে যাবে। বলতে গেলে আমি এখন অন্ধ।
এ বিষয়ে দিনা বেগম নামের এক প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া বলেন, রমজান মাসে বৃদ্ধা মরিয়ম বেগমকে তার ছেলে এখানে রেখে গেছেন। শোয়ার জন্য ঘরে ছোট একটি ভাঙা চৌকি দিয়েছিল। সেটি ছিল ছারপোকায় খাওয়া। পরে ওই চৌকি সরিয়ে ফেলা হয়। মরিয়ম বেগম এখন মাটিতে ঘুমান। এমন একজন বৃদ্ধা মাকে এভাবে একা অন্ধকার ঘরে রাখা খুবই অমানবিক। শুনেছি ছেলের বউ নাকি তাদের কাছে রাখতে চায় না। বউয়ের কথায় এখানে বৃদ্ধা মাকে ফেলে গেছে ছেলে। মরিয়ম বেগমের রান্নাবান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সব কাজ আমরা করে দেই।